পরমপিতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী
• মানুষ ঊষা-নিশায় যদি নামধ্যান করে,সকালে উঠে নাম ক'রে কষে ইষ্টভৃতি করে, এবং চলাফেরায় জপ চালায় নিয়মিতভাবে, তার বেকায়দায় পড়া অসুবিধা আছে। মানুষের আদত জিনিষ মাথা, মাথাটা যদি সুস্থ,সাবুদ,সক্রিয় থাকে, আর চলা যদি তদনুপাতিক হয়,তাহলে সে কী করতে পারে আর না পারে, তার কুল-কিনারা নাই।সব experimental fact(পরীক্ষিত সত্য)।
• যে খেয়াল বিবেকের অনুচর, তারই অনুসরণ কর, মঙ্গলের অধিকারী হবে।
• পরনিন্দা করাই পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া; আর, পরের সুখ্যাতি করা অভ্যাসে নিজের স্বভাব অজ্ঞাতসারে ভাল হ'য়ে পড়ে। তাই ব'লে কোন স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে অন্যের সুখ্যাতি ক'রতে নেই। সে তো খোসামোদ। সে-ক্ষেত্রে মন-মুখ প্রায়ই এক থাকে না। সেটা কিন্তু বড়ই খারাপ, আর তাতে নিজের স্বাধীন মত-প্রকাশের শক্তি হারিয়ে যায়।
* * যার-উপর যা'-কিছু-সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধৰ্ম্ম, আর তিনিই পরমপুরুষ। ধৰ্ম্ম কখনও বহু হয় না, ধৰ্ম্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই। মত বহু হতে পারে, এমন-কি যত মানুষ তত মত হ'তে পারে, কিন্তু তাই ব'লে ধৰ্ম্ম বহু হ'তে পারে না। হিন্দুধৰ্ম্ম, মুসলমানধৰ্ম্ম, খৃষ্টানধৰ্ম্ম, বৌদ্ধধৰ্ম্ম ইত্যাদি কথা আমার মতে ভুল, বরং ও-সবগুলি মত। কোনও মতের সঙ্গে কোনও মতের প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই, ভাবের বিভিন্নতা, রকমফেরএকটাকেই নানাপ্রকারে একরকম অনুভব!
• যে-কর্মে মনের প্রসারণ নিয়ে আসে তাই সুকৰ্ম্ম, আর যাতে মনে সংস্কার, গোঁড়ামি ইত্যাদি আনে, ফলকথা, যাতে মন সংকীর্ণ হয় তাই কুকর্ম।
• সংযত হও, কিন্তু নির্ভীক হও। সরল হও, কিন্তু বেকুব হয়াে না। তাই বলে দুৰ্বল হৃদয় হয়াে না।
• পৃথিবীর পূর্ধ্বতন অবতার, প্রেরিত ও মহাপুরুষদিগকে আপ্ত বলিয়া স্বীকার করা এবং সন্ত্ৰমের সহিত তাঁহাদের প্রতি সশ্রদ্ধ থাকা উচিত।
• বিনীত হও,.মানুষের নিজ প্রবৃত্তিগুলির আকাঙ্খপূরণের টানের চাইতে ইষ্টে বা ইঙ্গিতে বেশি টান না থাকিলে অদৃষ্ট বা সঞ্চিত কৰ্ম্মফলের বিরুদ্ধে কিছুতেই কৃতকার্য হওয়া যায় না।
• অর্থ, মান, যশ ইত্যাদি পাওয়ার আশায় আমাকে ঠাকুর সাজিয়ে ভক্ত হ’য়াে না, সাবধান হওঠকবে; তােমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ তােমার কেন্দ্রও নয়, ঠাকুরও নয়—ফাঁকি দিলেই পেতে হবে তা।
• জগতে মানুষ যত-কিছু দুঃখ পায় তাঁর অধিকাংশই কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থেকে আসে, ও দুটো থেকে যত দূরে সরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
• যদি ভাল চাও তো জ্ঞানাভিমান ছাড়, সব্বারই কথা শোন; আর, যা' তোমার হৃদয়ের বিস্তারের সাহায্য করে তা'ই কর।
• জ্ঞানাভিমান জ্ঞানের যত অন্তরায় আর কোন রিপু তত নয়। যদি শিক্ষা দিতে চাও তবে কখনই শিক্ষক হ'তে চেও না। আমি শিক্ষক, এই অহঙ্কারই কাউকে শিখতে দেয় না। অহংকে যত দূরে রাখবে তোমার জ্ঞানের বা দর্শনের পাল্লা তত বিস্তার হবে।
• অহংটা যখনই মিলিয়ে যায়, জীব তখনই সর্ব্বগুণসম্পন্ন-নির্গুণ হয়।
• যদি সাধনায় উন্নতি লাভ করতে চাও, তবে কপটতা ত্যাগ কর।
• প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী। প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্ন রূপ, এমনতর ভাবতে হয়।
• অমৃতময় বারি কপটের নিকট তিক্ত লবণময়, তীরে যাইয়াও তাঁর তৃষ্ণা নিবারিত হয় না।
• যদি শিক্ষা দিতে চাও তবে কখনই শিক্ষক হতে চেওনা। আমি শিক্ষক, এই অহঙ্কারই কাউকে শিখতে দেয় না।
• অসৎ কথা বলার চেয়ে সৎ কথা বলা ভাল নিশ্চয়, কিন্তু বলার সঙ্গে কাজ করা ও অনুভব না থাকলে কী হ’ললা—বেহালা, বীণা যেমন বাদানুগ্রহে বাজে ভাল, কিন্তু তারা নিজে কিছু অনুভব করতে পারে না।
• পরনিন্দা করাই পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া; আর, পরের সুখ্যাতি করা অভ্যাসে নিজের স্বভাব অজ্ঞাতসারে ভালো হয়ে পড়ে। তাই বলে কোনো স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে অন্যের সুখ্যাতি করতে নেই। সে তো তোষামোদ। সেক্ষেত্রে মন ও মুখ প্রায়ই এক থাকে না। সেটা কিন্তু বড়ই খারাপ, আর তাতে নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের শক্তি হারিয়ে যায়।• যেমন ডালিম পাকলেই ফেটে যায়, তােমার অন্তরে সৎভাব পাকলেই আপনি ফেটে যাবে—তােমায় মুখে তা প্রকাশ করতে হবে না।
• ধনী—হও ক্ষতি নাই, কিন্তু দীন, এবং দাতা হও। ধনবান যদি অহঙ্কারী হয়, সে দুর্দশায় অবনত হয়।
• সৎ-চিন্তায় নিমজ্জিত থাক, সৎ-কৰ্ম্ম তােমার সহায় হবে এবং তােমার চতুর্দিক সৎ হয়ে সকল সময় তােমাকে রক্ষা করবেই করবে।
• যেরূপ আদর্শে তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তােমার স্বভাবও সেইভাবে গঠিত হবে, আর তােমার দর্শনও তদ্রুপ হবে।
• .নিষ্ঠা রেখাে, কিন্তু গোঁড়া হয়াে না। সাধু সেজো না, সাধু হতে চেষ্টা কর।
• কোন মহাপুরুষের সঙ্গে তােমার নিজের তুলনা করাে না, কিন্তু সর্বদা তাঁর অনুসরণ কর।
• যখনই দেখবে, গুরুর আদেশে শিষ্যের আনন্দ হয়েছে, মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে, তখনই বুঝবে যে তার হৃদয়ে শক্তি এসেছে।
• গুরুকে আমার বলে জানতে হয়—মা, বাপ, পুত্র ইত্যাদি বাড়ির লােককে ভাবতে গেলে যেন তাঁর মুখও মনে পড়ে। গুরুই ভগবানের সাকার মূর্তি, আর তিনিই অখণ্ড।
• নিজ হাতে গুরুসেবা করলে অহঙ্কার পাতলা হয়, অভিমান দূরে যায়, আর প্রেম আসে।
• নাম করলেই হয়,নামে সব আবর্জ্জনা জ্ব'লে যায়।সর্ব্বক্ষণ নাম করতে হয়, কাজকর্ম্ম বাদ না দিয়ে।নাম করতে থাকলে প্রথম একটা জিনিষ হয়,ইষ্টের সান্নিধ্য-প্রলোভন দারুণ বেড়ে যায়।কিন্ত indolent (অলস)সান্নিধ্য-প্রলোভন,যা' সেবা-প্রধান নয়,তা' helpful(সহায়ক)হয় না।সান্নিধ্য -প্রলোভন হওয়া চাই তরতরে সেবাপ্রতুল।নাম খুব চেতানো লাগে অনুরাগ আবেগ নিয়ে--কর্ম্মপ্রবণতাকে প্রবুদ্ধ ক'রে। এতে চরিত্রে জমে ওঠা মলিনতার জটপাকান নীরেট জঞ্জালগুলি পুড়ে যায়,ফেটেফুটে যায়,আবার আসে normal balance ( স্বাভাবিক সমতা)।
• আমরা বদভ্যাসের কাছে এমনভাবে আত্মসমর্পণ করি যে, মনে হয়, যত ক্ষতি হয় হোক কিন্তু এটা ছাড়ব না। প্রবৃত্তির দাসত্ব হ'লে এমনতরই হয়, আর ইষ্টের প্রতি অনুরাগে আসে একটা wise conscious adjustment and manipulation of all complexes and obstacles (প্রবৃত্তি এবং বাধাগুলির প্রাজ্ঞ সচেতন বিন্যাস ও পরিচালনা)। এখানেও উপভোগ, ওখানেও উপভোগ। কিন্তু একটা যেন চিটে গুড় আর একটা যেন মিশ্রীর পানা। অদম্য অনুরাগে নিজেকে ইষ্টের সঙ্গে বেঁধে ফেলে সেইভাবে ঝাঁপ দিতে হয়, তবেই অসাধ্য সাধন করা যায়। শ্রীকৃষ্ণের বা বুদ্ধদেবের কি ভোগের বস্ত কম ছিল? কিন্তু কিছুই আকর্ষণ বিস্তার করতে পারল না তাঁদের মনের উপর। অত কঠোরতার মধ্যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানই তাঁদের কাছে প্রীতিপদ মনে হ'ল। এটা একটা প্রেরণাপ্রদীপ্ত উপভোগ। এতে সত্তার যে উল্লাস হয়, উদ্দীপনা হয়, তাতে কষ্টটাও সুখের মনে হয়। আমরা ঐ রস পাইনি ব'লে ওটাকে কষ্ট ব'লে মনে করি। কিন্তু যার মন মাতে, প্রাণ মাতে সে আদর্শের পূরণার্থে চরম দুঃখদুর্দশা হাসি মুখে বরণ ক'রে নেয়। তা যেন তার আনন্দের অপরিহার্য উপাদান।
• বন্ধুকে একটু কম ভালবাসিস্ ক্ষতি নাই, কিন্তু শত্রুকে খুব বেশী । সমুদ্রের জল থেকে লবণ বার করলে জলও খাদ্য, লবণও খাদ্য ।
• তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর বিভিন্ন প্রকৃতি আছে। বহুবিদ রকম আছে। সেই বহুদার মধ্য দিয়ে তিনি একধাকে জানতে চাই আমরা। তাই সঙ্গতীশীল কৃতিদীপ্ত অনুচলন ও ইষ্টনিষ্ঠা চাই। তা না হলে ঠিক ঠিক উপভোগই করা যায় না।
• মানুষের আত্মা যেমন অমর, নিষ্ঠাও তেমনি অমর। আমরা যে অমৃত-অমৃত করি, তার চাবিকাঠি হ’ল ইষ্টনিষ্ঠা। ইষ্টনিষ্ঠা যেই একজনকে পেয়ে বসে, তখন এক-একটা প্রবৃত্তির সিন্দুকের ডালা খুলে যেতে থাকে এবং বিভিন্ন প্রবৃত্তি ইষ্টমুখী অর্থাৎ একমুখী হ'তে থাকে। তখন বােঝা যায় কামের স্বরূপ কী, ক্রোধের স্বরূপ কী লােভ, মােহ,মাৎসর্য্যের স্বরূপ কী! এবং এগুলির প্রত্যেকটির সপরিবেশ নিজের সত্তাপােষণী বিনিয়ােগ করা যায় কিভাবে। তখন মানুষ প্রবৃত্তির হাতে গিয়ে পড়ে না, বরং প্রবৃত্তিগুলি তার হাতে খেলার পুতুলের মত হ'য়ে দাঁড়ায়। বেফাঁস চলন বন্ধ হ'য়ে যায়। এইভাবে মানুষের ভিতরে অখণ্ড ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা হয়। সে প্রাজ্ঞ হ'য়ে ওঠে। বােধিসত্ত্ব হ'য়ে ওঠে।
• একটা মেয়ে যদি ভ্রষ্টচরিত্রাও হয়, আর সে যদি পরে শ্রেষ্ঠপরায়ণা হ'য়ে ওঠে, তাহ'লে তার বরং নিস্তার আছে। কিন্তু কোন মেয়ে যদি দৈহিক পবিত্রতা বজায় রেখেও মানসিক অপবিত্রতা নিয়ে চলে, অথচ উদ্ধত দাম্ভিকতায় নিজের চাইতে শ্রেষ্ঠ ব'লে কাউকে ভাবতে না পারে, নিজের হামবড়াই প্রতিষ্ঠার খেয়ালই তা'র যথাসর্বস্ব হয়, তা'র ইহকাল- পরকালে গতি নেই। কতজনের বেলায় দেখা গেছে, শ্রেয়নিষ্ঠার ফলে তারা অমর হ'য়ে আছে। মেরী ম্যাগডালিন, আম্রপালী, পিঙ্গলা বেশ্যা। এদের জীবনের দিকে চেয়ে দেখ না?"
• ভাগ্য মানে ভজনফল বা কর্ম্মফল।ভাগ্য এসেছে ভজ-ধাতু থেকে।ভজ-ধাতু মানে ভক্তি, অনুরাগ, সেবা,আশ্রয়, প্রাপ্তি, বিভাগ, দান ইত্যাদি।অনেকের পূর্ব্বজন্মে অনেকখানি করা থাকে, যার ফল এ-জন্মে পায়।তাই মনে হয় কিছু না ক'রেও পেল।কিন্তু পেতে গেলেই করতে হয়।অবশ্য দাগাবাজি ক'রে পাওয়ার কথা,বলছি না।পূর্ব্বজন্মের সুকৃতির কথা যা' বললাম, ওর উপর নির্ভরশীল না হ'য়ে যা' পেতে গেলে যা করতে হয়, বর্ত্তমানকালে তা' বিধিমতো করার তালে থাকাই ভাল।ঐ করাই পাইয়ে দেয়।অদৃষ্টবাদী ও আলস্যপরায়ণ হ'লে মানুষ পদে-পদেই ঠ'কে যায়।যে যা' পায় তা' করেই পায়।আগের করা এগোন থাকলে কর্ম্মদক্ষতা, বুদ্ধি ও চরিত্র তদনুযায়ী বিকশিত হয়।তার বিহিত প্রয়োগে মানুষ এ-জন্মে অপেক্ষাকৃত কম চেষ্টায় কৃতকার্য্যতা লাভ করে।
• আমার বাবা বলতেন, "মানুষকে দিও, কিন্তু খুব বেশী দিও না, বেশী দিলে তার ক্ষতি হবে। আমি বলি, ততটুকু দিও যাতে সে বেঁচে থাকে। কিন্তু অভাব পুরোপুরি না ঘোচে, সেই অভাব পূরণের জন্য কিছু-কিছু খাটে, একেবারে আলসে যেন না হয়ে যায়। আর এমনভাবে দেওয়া ভাল যাতে ঐ দেওয়াটাই তোমার ক্ষতির কারণ না হয়।" কিন্তু মা বলতেন-"তা কেন? দেব তো যত পারব দেব, উজাড় ক'রে দেব, এমনভাবে দেব যে ডান হাতে দেব বাঁ হাত জানবে না-দেওয়ার মধ্যে আবার বিবেচনা কী?" -আমি এখন দেখছি-বাবার কথাই ঠিক। কিন্তু আমার প্রকৃতি এমন যে মা'র ধরণে না চ'লে পারি না।
• অনুতাপ কর; কিন্তু স্মরণ রেখো যেন পুনরায় অনুতপ্ত হতে না হয়। যখনই তোমার কুকর্ম্মের জন্য তুমি অনুতপ্ত হবে, তখনই পরমপিতা তোমাকে ক্ষমা করবেন, আর ক্ষমা হ'লেই বুঝতে পারবে, তোমার হৃদয়ে পবিত্র সান্ত্বনা আসছে, আর তা'হলেই তুমি বিনীত, শান্ত ও আনন্দিত হবে।
• জগতে মানুষ যত-কিছু দুঃখ পায় তা'র অধিকাংশই কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থেকে আসে, ও দুটো থেকে যত দূরে স'রে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
• ভগবান্ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব সবাইকে বিশেষ ক'রে বলেছেন, কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাৎ-তফাৎ-খুব তফাৎ থাক। কামিনী থেকে কাম বাদ দিলেই ইনি মা হ'য়ে পড়েন। বিষ অমৃত হ'য়ে গেল। আর মা মা-ই, কামিনী নয়কো। 'মা'র শেষে 'গী' দিয়ে ভাবলেই সর্ব্বনাশ। সাবধান! মাকে মাগী ভেবে ম'র না। প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী। প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্ন রূপ, এমনতর ভাবতে হয়। মাতৃভাব হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত না হ'লে স্ত্রীলোককে ছুঁতে নেই-যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল; এমন-কি মুখদর্শন না করা আরও ভাল।
• আমার কামক্রোধাদি গেল না, গেল না-ব'লে চীৎকার পাড়লে কখনই তারা যায় না। এমন কৰ্ম্ম, এমন চিন্তা, অভ্যাস ক'রে নিতে হয় যাতে কামক্রোধাদির গন্ধও নেই-মন যাতে ও-সব ভুলে যায়। মনে কামক্রোধাদির ভাব না এলে কী ক'রে তারা প্রকাশ পাবে? উপায়-উচ্চতর উদার ভাবে নিমজ্জিত থাকা।
• সৃষ্টিতত্ত্ব, গণিতবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ইত্যাদির আলোচনায় কাম-রিপুর দমন হয়। কামিনী-কাঞ্চন-সম্বন্ধীয় যে-কোন রকম আলোচনাই ওতে আসক্তি এনে দিতে পারে। ও-সব আলোচনা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল।
• সঙ্কোচই দুঃখ, আর প্রসারণই সুখ। যাতে হৃদয়ে দুর্ব্বলতা আসে, ভয় আসে-তাতেই আনন্দের খাঁকতি -আর তাই দুঃখ।
• চাওয়াটা না-পাওয়াই দুঃখ। কিছু চেও না। সব অবস্থায় রাজী থাক, দুঃখ তোমার কী করবে?
• দুঃখ কারো প্রকৃতিগত নয়কো, তা'কে ইচ্ছে ক'রলেই তাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
• পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর-'তোমার ইচ্ছাই মঙ্গল; আমি জানি না,কিসে আমার মঙ্গল হবে। আমার ভিতরে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক'। আর, তা'র জন্যে তুমি রাজী থাক-আনন্দে থাকবে, দুঃখ তোমাকেস্পর্শ ক'রবে না।
• কারো দুঃখের কারণ হ'য়ো না, কেহ তোমার দুঃখের কারণ হবে না।
• দুঃখও একরকম ভাব, সুখও একরকম ভাব। অভাবের বা চাওয়ার ভাবটাই দুঃখ। তুমি জগতের হাজার ক'রেও দুঃখ নষ্ট ক'রতে পারবে না-যতক্ষণ তুমি হৃদয় থেকে ঐ অভাবের ভাবটা কেড়ে না নিচ্ছ। আর, ধৰ্ম্মই তা' ক'রতে পারে।
• যদি সাধনায় উন্নর্তি লাভ ক'রতে চাও, তবে কপটতা ত্যাগ কর।
• কপটব্যক্তি অন্যের নিকট সুখ্যাতির আশায় নিজেকে নিজেই প্রবঞ্চনা করে, অল্প বিশ্বাসের দরুন অন্যের প্রকৃত দান হ'তেও প্রবঞ্চিত হয়।
• তুমি লাখ গল্প কর, কিন্তু প্রকৃত উন্নতি না হ'লে তুমি প্রকৃত আনন্দ কখনই লাভ ক'রতে পারবে না।
• কপটাশয়ের মুখের কথার সঙ্গে অন্তরের ভাব বিকশিত হয় না, তাই আনন্দের কথাতেও মুখে নীরসতার চিহ্ন দৃষ্ট হয়; কারণ, মুখ খুললে কী হয়, হৃদয়ে ভাবের স্ফুর্ত্তি হয় না।
• অমৃতময় বারি কপটের নিকট তিক্ত লবণময়, তীরে যাইয়াও তা'র তৃষ্ণা নিবারিত হয় না। সরল ব্যক্তি উর্দ্ধদৃষ্টিসম্পন্ন চাতকের মত। কপটী নিম্নদৃষ্টিসম্পন্ন শকুনের মত। ছোট হও, কিন্তু লক্ষ্য উচ্চ হোক্; বড় এবং উচ্চ হ'য়ে নিম্নদৃষ্টিসম্পন্ন শকুনের মত হওয়ায় লাভ কী?
• কপট হ'য়ো না, নিজে ঠ'ক না, আর অপরকে ঠকিও না .
• এটা খুবই সত্য কথা যে, মনে যখনই অপরের দোষ দেখবার প্রবৃত্তি এসেছে তখনই ঐ দোষ নিজের ভিতরে এসে বাসা বেঁধেছে। তখনই কালবিলম্ব না ক'রে ওই পাপপ্রবৃত্তি ভেঙ্গেচুরে ঝেটিয়ে সাফ্ ক'রে দিলে তবে নিস্তার, নইলে সব নষ্ট হ'য়ে যাবে।
• তোমার নজর যদি অন্যের কেবল কু-ই দেখে, তবে তুমি কখনই কাউকে ভালবাসতে পারবে না। আর, যে সৎ দেখতে পারে না সে কখনই সৎ হয় না।
• তোমার মন যত নির্মূল হবে, তোমার চক্ষু তত নিৰ্ম্মল হবে, আর জগৎটা তোমার নিকট নিৰ্ম্মল হ'য়ে ভেসে উঠবে। তুমি যা'ই দেখ না কেন, অন্তরের সহিত সর্ব্বাগ্রে তা'র ভালটুকুই দেখতে চেষ্টা কর, আর এই অভ্যাস তুমি মজ্জাগত ক'রে ফেল।
• তোমার ভাষা যদি কুৎসা-কলঙ্কজড়িতই হ'য়ে থাকে, অপরের সুখ্যাতি ক'রতে না পারে, তবে যেন কারো প্রতি কোনও মতামত প্রকাশ না করে। আর, মনে-মনে তুমি নিজ স্বভাবকে ঘৃণা ক'রতে চেষ্টা কর, এবং ভবিষ্যতে কুৎসা-নরক ত্যাগ ক'রতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হও।
• পরনিন্দা করাই পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া; আর, পরের সুখ্যাতি করা অভ্যাসে নিজের স্বভাব অজ্ঞাতসারে ভাল হ'য়ে পড়ে। তাই ব'লে কোন স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে অন্যের সুখ্যাতি ক'রতে নেই। সে তো খোসামোদ। সে-ক্ষেত্রে মন-মুখ প্রায়ই এক থাকে না। সেটা কিন্তু বড়ই খারাপ, আর তাতে নিজের স্বাধীন মত-প্রকাশের শক্তি হারিয়ে যায়।
• যার-উপর যা'-কিছু-সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধৰ্ম্ম, আর তিনিই পরমপুরুষ। ধৰ্ম্ম কখনও বহু হয় না, ধৰ্ম্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই। মত বহু হতে পারে, এমন-কি যত মানুষ তত মত হ'তে পারে, কিন্তু তাই ব'লে ধৰ্ম্ম বহু হ'তে পারে না। হিন্দুধৰ্ম্ম, মুসলমানধৰ্ম্ম, খৃষ্টানধৰ্ম্ম, বৌদ্ধধৰ্ম্ম ইত্যাদি কথা আমার মতে ভুল, বরং ও-সবগুলি মত।
• কোনও মতের সঙ্গে কোনও মতের প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই, ভাবের বিভিন্নতা, রকমফেরএকটাকেই নানাপ্রকারে একরকম অনুভব!
• সব মতই সাধনা বিস্তারের জন্য, তবে তা' নানাপ্রকারে হ'তে পারে; আর যতটুকু বিস্তারে যা' হয় তাই অনুভূতি, জ্ঞান। তাই ধৰ্ম্ম অনুভূতির উপর।
• যদি ভাল চাও তো জ্ঞানাভিমান ছাড়, সব্বারই কথা শোন; আর, যা' তোমার হৃদয়ের বিস্তারের সাহায্য করে তা'ই কর।
• জ্ঞানাভিমান জ্ঞানের যত অন্তরায় আর কোন রিপু তত নয়।
• যদি শিক্ষা দিতে চাও তবে কখনই শিক্ষক হ'তে চেও না। আমি শিক্ষক, এই অহঙ্কারই কাউকে শিখতে দেয় না।
• অহংকে যত দূরে রাখবে তোমার জ্ঞানের বা দর্শনের পাল্লা তত বিস্তার হবে।
• অহংটা যখনই মিলিয়ে যায়, জীব তখনই সর্ব্বগুণসম্পন্ন-নির্গুণ হয়।
• যদি পরীক্ষক সেজে অহঙ্কার নিয়ে সদ্গুরু কিংবা প্রেমী সাধুগুরুকে পরীক্ষা ক'রতে যাও তবেতুমি তাঁতে তোমাকেই দেখবে, ঠ'কে আসবে।
• সদ্গুরুকে পরীক্ষা ক'রতে হ'লে তাঁর নিকট সঙ্কীর্ণসংস্কারবিহীন হ'য়ে, ভালবাসার হৃদয় নিয়ে, দীন এবং যতদূর সম্ভব নিরহঙ্কার হ'য়ে যেতে পারলে তাঁর দয়ায় সন্তুষ্ট হওয়া যেতে পারে। তাঁকে অহং-এর কষ্টিপাথরে কষা যায় না,কিন্তু তিনি প্রকৃত দীনতারূপ ভেড়ার শিঙে খণ্ডবিখণ্ড হন।
• হীরক যেমন কয়লা প্রভৃতি আবর্জ্জনায় থাকে, উত্তমরূপে পরিষ্কার না ক'রলে তার জ্যোতি বেরোয় না, তিনি তো তেমনি সংসারে অতি সাধারণ জীবের মত থাকেন, কেবল প্রেমের প্রক্ষালনেই তাঁর দীপ্তিতে জগৎ উদ্ভাসিত হয়।
• প্রেমীই তাঁকে ধ'রতে পারে। প্রেমীর সঙ্গ কর, সৎসঙ্গ কর, তিনি আপনিই প্রকট হবেন।
• সত্যদর্শীর আশ্রয় নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা কর, এবং বিনয়ের সহিত স্বাধীন মত প্রকাশ কর। বই প'ড়ে বই হ'য়ে যেও না, তার essence (সার)-কে মজ্জাগত করতে চেষ্টা কর। Pull the husk to draw the seed. (তুষটা ফেলে শস্যটা নিতে হয়)।
• উপর-উপর দেখেই কিছু ছেড়ো না বা কোন মত প্রকাশ ক'র না। কোনও-কিছুর শেষ না দেখলে তা'র সম্বন্ধে জ্ঞানই হয় না,আর না জানলে তুমি তা'র বিষয় কী মত প্রকাশ ক'রবে?
• যা'ই কেন কর না,তা'র ভিতর সত্য দেখতে চেষ্টা কর। সত্য দেখা মানেই তাকে আগাগোড়া জানা, আর তাই জ্ঞান। যা' তুমি জান না, এমন বিষয়ে লোককে উপদেশ দিতে যেও না
• নিজের দোষ জেনেও যদি তুমি তা' ত্যাগ ক'রতে না পার, তবে কোনও মতেই তা'র সমর্থন ক'রে অন্যের সর্ব্বনাশ ক'র না।
• তুমি যদি সৎ হও, তোমার দেখা-দেখি হাজারহাজার লোক সৎ হ'য়ে পড়বে। আর, যদি অসৎ হও, তোমার দুর্দ্দদশার জন্য সমবেদনা প্রকাশের কেউই থাকবে না; কারণ,তুমি অসৎ হ'য়ে তোমার চারিদিক্ই অসৎ ক'রে ফেলেছ।
• তুমি ঠিক-ঠিক জেনো যে,তুমি তোমার, তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্ত্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী। নাম-যশের আশায় কোন কাজ ক'রতে যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু কোন কাজ নিঃস্বার্থভাবে ক'রতে গেলেই কার্য্যের অনুরূপ নাম-যশ তোমার সেবা ক'রবেই ক'রবে।
• নিজের জন্য যা'ই করা যায় তাই সকাম, 'আর, অন্যের জন্য যা' করা যায় তাই নিষ্কাম। কারো জন্য কিছু না-চাওয়াকেই নিষ্কাম বলে-শুধু তা' নয়কো।
• দিয়ে দাও, নিজের জন্য কিছু চেও না, দেখবে, সব তোমার হ'য়ে যাচ্ছে।
• তুমি অন্যের নিকট যেমন পেতে ইচ্ছা কর, অপরকেও তেমনি দিতে চেষ্টা কর-এমনতর বুঝে চ'লতে পারলেই যথেষ্ট-আপনি সব্বাই তোমাকে পছন্দ ক'রবে, ভালবাসবে।
• নিজে ঠিক থেকে সব্বাইকে সৎভাবে খুশি করতে চেষ্টা কর, দেখবে সব্বাই তোমাকে খুশি করতে চেষ্টা ক'রছে। সাবধান, নিজত্ব হারিয়ে কাউকে খুশি ক'রতে যেও না, তাহ'লে তোমার দুর্গতির সীমা থাকবে না।
• কাজ ক'রে যাও কিন্তু আবদ্ধ হ'য়ো না। যদি বিষয়ের পরিবর্ত্তনে তোমার হৃদয়ে পরিবর্তন আসছে বুঝতে পার, আর সে-পরিবর্তন তোমার বাঞ্ছনীয় নয়, তবে ঠিক জেনো, তুমি আবদ্ধ হয়েছ।
• কোনপ্রকার সংস্কারেই আবন্ধ থেকো না, একমাত্র পরমপুরুষের সংস্কার ছাড়া যা'-কিছু সবই বন্ধন।
• তোমার দর্শনের-জ্ঞানের পাল্লা যতটুকু অদৃষ্ট ঠিক তা'রই আগে; দেখতে পাচ্ছ না, জানতে পাচ্ছ না, তাই অদৃষ্ট।
• তোমার শয়তান অহঙ্কারী আহাম্মক আমিটাকে বে'র ক'রে দাও; পরমপিতারইচ্ছায় তুমি চল, অদৃষ্ট কিছুই ক'রতে পারবে না। পরমপিতার ইচ্ছাই অদৃষ্ট। তোমার সব অবস্থার ভিতর তাঁর মঙ্গল-ইচ্ছা বুঝতে চেষ্টা কর, দেখবে কাতর হবে না, বরং হৃদয়ে সবলতা আসবে, দুঃখেও আনন্দ পাবে।
• কাজ ক'রে যাও, অদৃষ্ট ভেবে ভেঙ্গে প'ড় না; আল্ েহ'য়ো না, যেমন কাজ ক'রবে তোমার অদৃষ্ট তেমনি হ'য়ে দৃষ্ট হবেন। সৎকর্মীর কখনও অকল্যাণ হয় না। একদিন আগে আর পাছে। পরমপিতার দিকে তাকিয়ে কাজ ক'রে যাও। তাঁর ইচ্ছাই অদৃষ্ট; তা' ছাড়া আর-একটা অদৃষ্ট-ফদৃষ্ট বানিয়ে বেকুব হ'য়ে ব'সে থেকো না। অনেক লোক অদৃষ্টে নেই ব'লে হাল ছেড়ে দিয়ে ব'সে থাকে, অথচ নির্ভরতাও নেই, শেষে সারা জীবন দুর্দ্দদশায় কাটায়, ওসব আহাম্মকী।
• তোমার তুমি গেলেই অদৃষ্ট ফুরুলো, দর্শনও নাই, অদৃষ্টও নাই।
এগিয়ে যাও, কিন্তু মেপে দেখতে যেও না কতদূর এগিয়েছ; তাহ'লে আবার পিছিয়ে প'ড়বে।
• অনুভব কর, কিন্তু অভিভূত হ'য়ে প'ড় না, তাহ'লে চ'লতে পারবে না। যদি অভিভূত হ'তে হয় তো ঈশ্বরপ্রেমে
• যত পার সেবা কর, কিন্তু সাবধান, সেবা নিতে যেন ইচ্ছা না হয়।
• অনুরোধ কর, কিন্তু হুকুম ক'রতে যেও না।
কখনও নিন্দা ক'রো না,কিন্তু অসত্যের প্রশ্রয় দিও না।
• ধীর হও, তাইব'লে আ, দীর্ঘসূত্রী হ'য়ে প'ড় না।
• ক্ষিপ্র হও, কিন্তু অধীর হ'য়ে বিরক্তিকে ডেকে এনে সব নষ্ট ক'রে ফেলো না।
• বীর হও, কিন্তু হিংস্রক হ'য়ে বাঘ-ভালুক সেজে ব'স না।
• স্থিরপ্রতিজ্ঞ হও, গোঁয়ার হ'য়ো না।
• তুমি নিজে সহ্য ক'র,কিন্তু যে পারে না তাকে সাহায্য কর, ঘৃণা ক'রো না, সহানুভূতি দেখাও, সাহস দাও।
• নিজেকে নিজে প্রশংসা দিতে কৃপণ সাজ, কিন্তু অপরের বেলায় দাতা হও।
• যার উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ, আগে তা'কে আলিঙ্গন কর, নিজ বাটীতে ভোজনের নিমন্ত্রণ কর, ডালা পাঠাও, এবং হৃদয় খুলেবাক্যালাপ না-করা পর্য্যন্ত অনুতাপের সহিত তার মঙ্গলের জন্য পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর; কেন না,বিদ্বেষ এলেই ক্রমে তুমি সংকীর্ণহ'য়ে প'ড়বে, আর সংকীর্ণতাই পাপ।
• যদি কেহ তোমার কখনও অন্যায় করে, আর একান্তই তার প্রতিশোধ নিতে হয়, তবে তুমি তা'র সঙ্গে এমন ব্যবহার কর যাতে সে অনুতপ্ত হয়; এমনতর প্রতিশোধ আর নেই-অনুতাপ তুষানল। তাতে উভয়েরই মঙ্গল।
Reviewed by Wisdom Apps
on
July 13, 2021
Rating:















bhalo lagle comment korun
ReplyDelete