হকির যাদুকর - ধ্যানচাঁদ ও ভারতীয় ক্রিকেটের জনক - রণজিৎ সিংজী - সমন্ধে কিছু কথা

ধ্যানচাঁদ 




পরপর পাঁচটি অলিম্পিক ক্রীড়ায় হকি খেলাতে স্বর্ণপদক পেয়ে ভারত যে নজির সৃষ্টি করে গেছে, আজও তা অম্লান।
মুখ্যত যে হকি খেলোয়াড়ের প্রতিভা ও নৈপুণ্যে ভারতের এই গৌরব, তিনি হলেন ধ্যানচাঁদ। স্বদেশপ্রেমী ধ্যানচাঁদ আগামী দিনের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলে গেছেন, 'Keep the flag of India flying.'
১০৯৫ খৃষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট এলাহাবাদে জন্ম ধ্যানচাঁদের। ধ্যানচাঁদের বাবা ও বড়ো ভাই ছিলেন মিলিটারিতে। ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ধ্যানচাঁদও সেনাদলে যোগ দেন। তাঁর হকিগুরু বলে তেওয়ারী ছিলেন ওই একি রেজিমেন্টে। তেওয়ারী ধ্যানচাঁদকে গভীরভাবে অনুশীলন করাতেন হকি খেলার ময়দানে। অল্পদিনেই ধ্যানচাঁদের প্রতিভাকে বিচ্ছুরিত হতে দেখা গেল। স্টিকের মাথায় যেন বল আঠা দিয়ে আটকানো ও ধ্যানচাঁদ একের পর এক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সর্পিল গতিতে বার বার হানা দিচ্ছেন বিপক্ষের গোলমুখে। প্রতিপক্ষের গোলের মালা পরিয়ে ছাড়েন। 
হকি খেলোয়াড় ধ্যানচাঁদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতময়। ১৯২২ থেকে ১৯২৬ অবধি ভারতীয় সেনাদলের হয়ে খেলেছেন ধ্যানচাঁদ। ইচ্ছে মতন গোল করেছেন। 
ফৌজি দলের হয়ে নিউজিল্যান্ডের সফর করেন ধ্যানচাঁদ। তাঁর খেলার চমৎকারিত্ব দেখে সকলে বিস্মিত। সেই সময়ে রটে যায়, ভারতের ফৌজি দলের এমন একজন খেলোয়াড় আছেন, যাকে প্রতিরোধ করতে বিপক্ষ দলের এগারোজন খেলোয়াড়ও যথেষ্ট নয়।
১৯২৮ খৃষ্টাব্দের বিশ্ব অলিম্পিকে অংশ নিতে গেল ভারতীয় হকি দল। ধ্যানচাঁদ এর অন্যতম সদস্য। অলিম্পিকে এই দল পরপর পরাজিত করে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ড। প্রতিটি খেলায় গোল করেছেন ধ্যানচাঁদ। ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ হল্যান্ড। প্রবল জ্বর নিয়েও ফাইনালে খেলেন ধ্যানচাঁদ ও হল্যান্ডকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেন। সেটাই ভারতের প্রথম অলিম্পিকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্তি।
১৯৩২ খৃষ্টাব্দের লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে হকি দলের সঙ্গে এলেন ধ্যানচাঁদ। ফাইনালে অমেরিকাকে হারালেন ২৪-০ গোলে। আজ অবধি এটা একটা রেকর্ড। সেবার ধ্যানচাঁদ মোট ১৩৩টি গোল করেছিলেন অতিমানবীয় দক্ষতায়। 
ধ্যানচাঁদকে দেওয়া হল নবাবী খিলাত উপাধি।
১৯৩৪ খৃষ্টাব্দে এশিয়াটিক গেমসে ভারতীয় হকি দলের অধিনায়কত্ব করেন ধ্যানচাঁদ। প্রতিটি খেলায় এই দল জিতেছিল।
ধ্যানচাঁদ অধিনায়ক হয়ে ১৯৩৫-এ নিউজিল্যান্ড যান সফরে। সেবারও ভারতীয় হকি দল সর্বত্র বিজয়ী। সেই সফরে ধ্যানচাঁদ একাই করেন ২০১টি গোল।
১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে অলিম্পিকে ধ্যানচাঁদের নেতৃত্বে ভারতীয় হকিদল আবার স্বর্ণপদক পায়। সেবার তিনি একাই গোল করেন ৫৯টি।
১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে তিনি কমিশনড অফিসার হন সেনাদলের।
বার্লিন অলিম্পিকে তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হিটলার তাঁকে জার্মানির নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিলেন। 
প্রথম শ্রেণীর খেলা থেকে ধ্যানচাঁদ অবসর নেন ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে। 
১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে তাঁকে শেষবারের মত দেখা গিয়েছিল কলকাতায় একটি প্রদর্শনী ম্যচে।
১৯৫৬ খৃষ্টাব্দে ভারত সরকার ধ্যানচাঁদকে 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করে। 
শেষ বয়সে ধ্যানচাঁদ চরম অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন । চেহারার অবস্থা এমন হয়েছিল যে একবার এক স্টেডিয়ামে খেলার আয়োজকরা ওনাকে চিনতে না পেরে প্রবেশ করতে পর্যন্ত দেননি । লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর হকির যাদুকর পরলোক যাত্রা করেন।
ধ্যানচাঁদের জন্মদিন, ২৯শে আগস্ট ভারতে পালিত হয় জাতীয় ক্রীড়াদিবস হিসাবে। 



রণজিৎ সিংজী


ক্রিকেট খেলায় ভারত আজ অন্যতম শক্তিশালী দেশ। কিন্তু এমন এক সময় ছিল, যখন নাক উঁচু ইংরেজরা মনে করত, ভারতবাসী ক্রিকেট খেলার যোগ্য নয়। তাদের এই ধারণা ও অহংকার প্রথম যিনি চুর্ন করেন তিনি হলেন ক্রিকেটের রাজপুত্র রণজিৎ সিংজী। ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়িয়ে তিনি এমন সমস্ত মার মেরেছেন, যা ক্রিকেট খেলার অভিধানে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে। বিশেষত তাঁর 'লেগ গ্লান্স' মার ছিল অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত, অনবদ্য। তাঁর জীবনীকার রোনাল্ডো ওয়াইল্ড এইভাবে লিখেছেন, '............Thus was born the greatest scoring stroke ever known.
For Ranjit Singhi, with his right foot perforce immovable, still refused to play on the defensive. To the amazement of the bowlers he twisted his body, flick his wrists, and smashed the ball round the leg. They sent him good length balls and he treated them in the same manner. They declared that it was risky, unconventional and in fact 'not cricket'. His reply was to score 'fours' of them.'
এই রণজিৎ সিংজী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলায় ৭২ বার শতরান করেন তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
রণজিৎ সিংজীর জন্ম ভারতের জামনগরে ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে । তিনি ছিলেন জামনগরের রাজা বিভাজীর দত্তক পুত্র।
রণজিৎ সিংজী যাতে সিংহাসনে বসতে না পারেন তারজন্য পারিবারিক চক্রান্ত চলছিল। পড়াশুনার অজুহাতে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইংল্যান্ডে। 
১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে সিংজী কেমব্রিজে এসে ভর্তি হন ট্রিনিটি কলেজে।
তাঁর দুই শিক্ষক চেষ্টার ম্যাকনাটেল এবং আর.এস.গুডচাইল্ডের হাতে ক্রিকেটের পাঠ গ্রহণ। পরে রিচার্ডসন, লকউড, ওয়াট, হাওয়ার্ড প্রমুখ বিখ্যাত বোলারদের বিরুদ্ধে তিনি বুক চিতিয়ে ব্যাট করতে থাকেন। সিংজীর খেলার ভঙ্গী ছিল একেবারে নিজস্ব। এ সম্পর্কে তাঁর নিজেরই উক্তি 'I found a great difference between the English style and my own.'
১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি 'ইউনিভার্সিটি ব্লু' হন।
১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনি ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে স্থান পেলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টেই দুই ইনিংসে করলেন ৬২ এবং ১৫৪ (নট আউট) রান। তাঁর একার দক্ষতায় নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে ইংল্যান্ড রক্ষা পায়।
সেই বছরই মোট ২,৭৮০ রান করে রণজিৎ সিংজী ব্যাটিং এভারেজ প্রথম স্থান অধিকার করেন। ডবলিউ জি গ্রেসকে তিনি ছাড়িয়ে যান। গ্রেস তখন বলেছিলেন, 'আপনি একশ' বছর জীবিত থাকলেও এ রকম দ্বিতীয় কোনও খেলোয়াড় পাবেন না, যিনি আমাকে এ ভাবে টপকে যেতে পেরেছেন।'
১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ টেস্ট দলের সদস্য হয়ে সিংজী অস্ট্রেলিয়া সফরে যান। 
সিডনিতে প্রথম টেস্টে তিনি খেলে দেন ১৭০ রানের একটি চমকপ্রদ ইনিংস। 
আর একটি টেস্টে অসুস্থ শরীর নিয়েও করেন ১৮৯ রান। অস্ট্রেলিয়া সফরে সেবার তাঁর সংগ্রহ ছিল ১০৭২ রান। বিপুল সাড়া তোলে তাঁর ব্যাটিং। তিনি মোট ১৪ টি টেস্ট খেলেছেন। সবগুলিই ইংল্যান্ডের হয়ে। 
জীবনে তাঁর সংগৃহীত রান পঁচিশ হাজারের অধিক। ইনিংস প্রতি রানের গড় ৫৬।
১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের ২ জুন ক্রিকেটের এই বিস্ময়পুরুষ ইহলোক ত্যাগ করেন।

  
হকির যাদুকর - ধ্যানচাঁদ ও ভারতীয় ক্রিকেটের জনক - রণজিৎ সিংজী - সমন্ধে কিছু কথা হকির যাদুকর - ধ্যানচাঁদ ও ভারতীয় ক্রিকেটের জনক - রণজিৎ সিংজী - সমন্ধে কিছু কথা Reviewed by Wisdom Apps on জানুয়ারী ১১, ২০২০ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.