গ্যালিলিওর অবস্থা দেখে কেঁদেছিলেন এই বিজ্ঞানী - ইভানজেলিস্তা টরিসেলির জীবনী

ইভানজেলিস্তা টরিসেলি (জন্ম : ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ)

ছোটোবেলা কেটে গিয়েছিল চার্চের কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ আবহাওয়ার মধ্যে। মন দিয়ে বাইবেল পড়তে হয়েছিল। ওল্ড টেস্টেমেন্টের এক একটি নির্দেশনামা মুখস্থ করতে হয়েছিল চোখ বন্ধ করে। মাঝে মধ্যে হৃদয় বিদ্রোহী হয়ে উঠত। তবুও কিছু করতে পারতেন না অসহায় টরিসেলি। তখনকার দিনে এটাই ছিল সামাজিক নিয়ম। ভালো ছাত্রদের যেতে হবে জেসুইটদের স্কুলে। খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা তখন নানা জায়গাতে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের একটি বিশেষ শাখা জেসুইট মনে পরিচিত ছিল । জেসুইটরা ধর্মবিদ্যাকে প্রসারের উদ্দেশ্যে উত্তর ইতালিতে অনেক স্কুল খুলেছিলেন। এমনই একটি স্কুলে টরিসেলির বাল্যশিক্ষা শুরু হয়।
জন্মেছিলেন তিনি উত্তর ইতালির কায়েঞ্জা শহরে। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই অক্টোবর পৃথিবীর বুকে এসেছিলেন টরিসেলি। মা বাবা ছিলেন নেহাত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল ওই পরিবারটির মধ্যে। ছোটো থেকেই তাঁরা চেয়েছিলেন টরিসেলিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। সুযোগ থাকলে হয়তো তাঁরা টরিসেলিকে অন্য কোথাও পাঠাতেন। কিন্তু তখন বিদ্যাশিক্ষা হত শুধুমাত্র জেসুইটদের স্কুলে। ফায়েঞ্জা শহরে তখন একাধিক জেসুইট স্কুল স্থাপিত হয়েছে।
অসাধারন মেধা নিয়ে জন্মেছিলেন টরিসেলি। যা একবার শুনতেন তা সহজেই ভুলতেন না। যে পড়তেন তা তাঁর মনের ভিতর গেঁথে যেত। এই স্কুলে ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞানের সহজ পাঠও শেখানো হত। ছোটোবেলা থেকেই টেরিসেলি বিজ্ঞানের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। স্কুলের সব কটি পরীক্ষাতে প্রথম হতেন তিনি। প্রথম হওয়াটাকে এভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন টরিসেলি। প্রত্যেকবার পরীক্ষার শেষে ফল ঘোষণা হত। টেরিসেলি জানতেন প্রথম পদকটি তাঁর বাঁধা।
স্কুলের দিনগুলি শেষ হয়ে গেল। বিজ্ঞানজিজ্ঞাসু মন নিয়ে টরিসেলি ভর্তি হলেন বিখ্যাত কলেজিও দ্য সাপিয়েঞ্চা মহাবিদ্যালয়।
সেখানেই একদিন লাইব্রেরিতে গ্যালিলিওর মহাকাশ তত্ত্বের উপর লেখা একটি বই হাতে পেলেন টরিসেলি। এই বইটি গোগ্রাসে গিলেছিলেন তিনি। কলেজের ক্লাস মাথায় উঠল। রোমের লাইব্রেরিগুলিতে তখন তিনি হানা দিচ্ছেন এক অভিযাত্রীর মতো। গ্যালিলিওর বই কোথায় আছে, অনুসন্ধান করে ফিরছেন তিনি। অনুগ্রহ করে একটি কপি আমাকে পড়তে দেবেন - এটাই ছিল টরিসেলির একান্ত অনুরোধ। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে তাকাতেন টরিসেলির মুখের দিকে। শৈশবসুলভ সারল্য এখনো লেগে আছে থুতনিতে। দুটি চোখে অবাক বিস্ময় খেলা করছে। প্রবীণ লাইব্রেরিয়ানের মনে কি এক ভাবনার উদয় হত। তিনি বিশেষ অনুমতি দিতেন টরিসেলিকে। টরিসেলি ঢুকে পড়তেন সেই গ্রন্থাগারের মধ্যে। সারাদিন কেটে যেত গ্যালিলিওর বই পড়ে পড়ে।
রোমে একাধিক গ্রন্থাগার এবং সংগ্রহশালা ছিল। সেখানে ঘুরে ঘুরে গ্যালিলিওর বেশ কয়েকটা বই পেলেন টরিসেলি। পড়ে ফেললেন। অতৃপ্তি আরো বেড়ে গেল। গ্যালিলিও যেন অদৃশ্য আকর্ষনে ঢাক দিচ্ছেন টরিসেলিকে। বলছেন - 'টরিসেলি তুমি আমার কাছে এসো। আমি তোমার জন্যে সাজিয়ে রেখেছি আধুনিক বিজ্ঞানের মনিমুক্ত। তুমি তা গ্রহণ করো। আমাকে উদ্ধার করো কূপমন্ডুকতার অন্ধকার থেকে।'
শেষ অব্দি অবশ্য টরিসেলির এই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। তেত্রিশ বছর বয়সে তিনি ফ্লোরেন্স শহরে এসে গ্যালিলিওর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আগ্নেয়গিরি তখন অনেকখানি নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। তা থেকে আর ধূম উদগীরণ হচ্ছে না। বোধহয় বিপক্ষ দলের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ফুরিয়ে গিয়েছিলেন গ্যালিলিও। প্রিয় বিজ্ঞানীর এই অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন টরিসেলি। তবুও যা আছে, তাই বা কম কি!
এই হলেন ইভান জেলিস্তা টরিসেলি। গ্যালিলিওকে গুরু বলে মেনে বিজ্ঞানের জগতে তার আবির্ভাব। টরিসেলি অনেকগুলি তত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তার মধ্যে যার জন্য তিনি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন, সেটি হল বায়ুর চাপ। তার নামেই বায়ুর চাপ পরিমাপক যন্ত্রের নাম হয়ে ওঠে টরিসেলি নল। "বায়ুচাপ সম্পর্কিত দিক নির্দেশক" প্রবন্ধটি টরিসেলি লিখেছিলেন ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বলেছিলেন, 'আমরা বাতাসের মহাসমুদ্রে ডুবে আছি। এই সমুদ্রের গভীরতা পাঁচশো মাইলের বেশি।' তিনি আরো বলেছিলেন যে, 'এই গভীর বায়ুসমুদ্রের একেবারে তলদেশে আমরা আছি। এই বাতাসের ওজন জলের ঘনত্বের আটশো ভাগের একভাগ মাত্র।'
টরিসেলির তত্ত্ব আজও আমরা অভ্রান্ত বলে মেনে চলেছি। যদিও নানা বিজ্ঞানী নানাভাবে এই তত্ত্বের আরো উন্নতিসাধন করেছেন, কিন্তু পথপ্রদর্শক হিসেবে তাকে আমরা নস্যাৎ করতে পারিনা। ব্যারোমিটার আবিষ্কার করার পর গ্যালিলিওর দুরবিনের সংস্কার তার অন্যতম।
আর একটা কথা শুনে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে যাবে, এই টরিসলি প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নকশা তৈরি করেছিলেন। ভাগ্য সহায় হলে তাকেই আমরা অনুবিক্ষন যন্ত্রের আবিষ্কারকের আসনে বসাতে পারতাম। তিনি প্রথম অনুধাবন করেছিলেন যে এই পৃথিবীতে এমন অনেক বস্তু আছে যাদের আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না। তাদের দেখতে বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন।
মাত্র  ৩৯ বছর বয়সে টরিসেলির জীবনে অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসে। বিজ্ঞানী হিসেবে তখন তিনি খ্যাতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছেন। প্রকৃতির কি নির্মম পরিহাস, ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে অক্টোবর, মাত্র ৩৯ বসন্তের টরিসেলি মহাকাশের তারা হয়ে গেলেন। পড়ে রইল তার সবকিছু। রইল অসমাপ্ত কবিতা, অগ্রন্থিত গল্প এবং না-বলা ইতিহাস।

গ্যালিলিওর অবস্থা দেখে কেঁদেছিলেন এই বিজ্ঞানী - ইভানজেলিস্তা টরিসেলির জীবনী গ্যালিলিওর অবস্থা দেখে কেঁদেছিলেন এই বিজ্ঞানী -  ইভানজেলিস্তা টরিসেলির জীবনী Reviewed by Wisdom Apps on সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.