কার্বন ন্যানোটিউব কি ?
আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিল যে বিশুদ্ধ কার্বনের সুসজ্জিত গঠন দুট----গ্রাফাইট ও হীরে। দুটোই খুব ভাল করে চিনি আমরা। হীরে আমাদের গহনায়, হীরে কাঁচ কাটার কারখানায়, হীরে গল্পে, হীরে স্বপ্নে। আর গ্রাফাইট পেন্সিলের শীষে। বাকি বিশুদ্ধ কার্বন আমাদের কাছে ধরা দেয় অনিয়মিত রুপে। যেমন ভুসো কালি। এই ধারনা পাল্টে গেল ১৯৮৪ সালে। পরপর কিছু ঘটনার প্রবাহে, পরিক্ষায়, গবেষণায় বেরিয়ে এল বিশুদ্ধ কার্বনের নতুন রুপ----ব্যকিবল(bucky ball) শুধুমাত্র যে একটি নতুন অণু আবিষ্কৃত হল তা নয়, উদ্ভাসিত হল নতুন নতুন অণুর এক অসীম জগৎ। কোনওটাতে কার্বন পরমাণুর সংখ্যা ষাট, কোনওটাতে সত্তর আবার কোনওটাতে চুরাশি এরকম। এরা হল ফুলরিন। প্রত্যেকটা যেন কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি খাঁচা। সেখানে প্রত্যেক পরমাণু আরও তিনটে কার্বন পরমাণুর সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ। যেমন থাকে গ্রাফাইটে। গ্রাফাইটের সঙ্গে অমিল অবশ্য ঢের। প্রত্যেক ফুলারিন অণুতে ঠিক বারোটা পঞ্চভুজ আর বিভিন্ন সংখ্যক ষড়ভুজ। ব্যকিবল যতে কার্বন পরমাণুর সংখ্যা ষাট, তাতে ষড়ভুজের সংখ্যা কুড়ি।
ফুলারিন গোষ্ঠীর অনুদের আকারও বিভিন্ন রকমের। ব্যকিবলের আকার বলেরই মত। সত্তরটা কার্বন পরমাণু রয়েছে যাতে তার আকার রাগবি বলের মত, একটু লম্বাটে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ডক্টর রিচার্ড স্মলে ১৯৯০ সালে বলেন, একটা লম্বা নলের মত ঢাকনা দিয়ে। আরও যে বৈশিষ্ট্য থাকবে ঐ নল বা টিউবে তা হল কোনও পঞ্চভুজ থাকবে না, সব হবে ষড়ভুজ। অন্য এক বিজ্ঞানী মিলি ড্রেসেলহস এই ধারনার কথা শুনে প্রস্তাবিত নলের নাম দেন বাকিটিউব। সে নাম অবশ্য টেকেনি।
১৯৯১ সালে জাপানের একজন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ বিশেসজ্ঞ সুমিও ইজিমা খুঁজে পেলেন ন্যানো মাপের কার্বন নল। অনেকটা যেমন বলেছিলেন বিজ্ঞানী স্মলে। তবে সেগুলো বহুস্তরীয় বা বলা যায় অনেকগুলো দেওয়াল বিশিষ্ট। আরও দু'বছর পর তিনি সত্যি খুঁজে পেলেন একটি মাত্র দেওয়াল বিশিষ্ট কার্বন ন্যানো টিউব। ব্যকিটিউব। ন্যানটিউব নামটাই অবশ্য টিকে রয়েছে। ঐ সময়ই আই বি এম কোম্পানির ডেভিড বেথুন খুঁজে পান এক দেওয়ালের ন্যানোটিউব। সম্পূর্ণ পৃথকভাবে। অবশ্য বিজ্ঞজনেরা বলেন যে এঁদের আগেই ন্যানোটিউব আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। কীরকম ?
কার্বন নামের বিজ্ঞান পত্রিকায় ২০০৬ এর এক সংখ্যার সম্পাদকীয়তে দু'জন লেখক, মার্কমন্থিয়ুক্স এবং ভ্লাদিমির কুজনেৎসভ মন্তব্য করেন যে কার্বন ন্যানোটিউব আবিস্কারের কয়েকজন আদি কর্তাকে ভুলে যাওয়া হয়েছে। ১৯৫২ সালে রাশিয়ার জার্নাল আফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি'তে রাদুস্কোভিচ এবং লুকিয়ানভিচ একদম পরিস্কার ভাবে রাশিয়া আর আমেরিকার ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। রুশ ভাষায় লেখা ওই প্রবন্ধ পাশ্চাত্যে হয় পৌঁছায়নি নয়ত সে ভাবে কেউ নজর করেনি। ইজিমার আসায় সরাসরি তা চোখে দেখা যায়নি বা ছবি তৈরি করা যায়নি। ইজিমার কৃতিত্বকে খর্ব করার জন্য আরও তথ্য রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ওবারলিন, এন্ডো এবং কোয়ামার প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে পরিস্কারভাবে ফাঁপা কার্বন তন্তুর অস্তিত্বের উল্লেখ করা হয়। এই তন্তুর ব্যাসার্ধও ন্যানো মাপের ছিল। ১৯৮১ সালে ইউক্রেনের এক দল বিজ্ঞানী কার্বন ন্যানোটিউবের মত গঠনের উল্লেখ করেন। ১৯৮৭ সালে এক মার্কিন রাসায়নবিদ হাওয়ার্ড টেনেন্ট মার্কিন দেশের পেটেন্ট পান ন্যানটিউবের মতই গঠন আবিস্কারের জন্য। তবে যেহেতু পেটেন্টের কথা হচ্ছে সেক্ষেত্রে এখানে 'আবিস্কার' করা যাবে না। আবিস্কারের জন্য কেউ পেটেন্ট পায় না। পায় উদ্ভাবনের জন্য। হাওয়ার্ড টেনেন্ট বস্তুতপক্ষে ন্যানোটিউব তৈরি করেছিলেন। যাই হোক, এই যে ন্যানটিউবের আবিস্কার ঘিরে এত দাবি, এত তথ্যের লড়াই, এর একটা বড় প্রয়োজন দেখা দেবে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময়। ন্যানটিউবের জন্য যে একটা নোবেল পুরস্কার বাঁধা এমনটা সবাই মনে করেছেন। কে বা কারা সেটা পাবেন তা নির্ভর করবে তথ্যের লড়াইয়ে কে জয়ী হবেন, তার উপর।
কিভাবে তৈরি হয় কার্বন ন্যানোটিউব ?
ন্যানোটিউবটিকে একটু অন্য ভাবে দেখা সম্ভব। যদি গ্রাফাইটের দিকে তাকাই তবে দেখব তা আসলে উপর-নীচে পর পর রাখা কয়েকটা কার্বনের তৈরি চাদর। প্রত্যেকটা চাদরে কার্বন পরমাণুগুলো জুড়ে জুড়ে ষড়ভুজ তৈরি করে। এখানে কোনও পঞ্চভুজ নেই। গ্রাফাইটের এই একটা চাদরই এগরোল বা মটনরোল পাকানোর মত মুড়ে দিলে পাওয়া যায় কার্বনের ন্যানোটিউব। তবে এগরোল বা মটনরোল যেমন গোল পাকানোর পর জোড়ার জায়গাটা স্পষ্ট থাকে, কার্বন ন্যানোটিউবে তেমনটা থাকে না। এখানে কোনও জোড় খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আবার, এটাও বলা উচিত যে এখানে আমরা রোলের তুলনা দিলেও পারমানবিক স্তরে হাত দিয়ে মোড়ার কাজটা সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে তৈরি হয় ন্যানটিউব।
১৯৯৩ সালে ইজিমা তৈরি করেন কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন (CVD) পদ্ধতি। এখানে কার্বন রয়েছে এমন কোনও একটা গ্যাসকে ভেঙে যেতে দেওয়া হয়। ভেঙে যাওয়া মানে তার আনবিক গঠন ভেঙে যাওয়া। এর ফলে বেরিয়ে আসে কার্বন পরমাণু। সেগুলো ফের নিজেরা জোট বেঁধে কার্বন ন্যানোটিউব গড়ে তোলে। এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ কার্বন ন্যানোটিউব পাওয়া যায়। অন্য একটা পদ্ধতিতে গ্রাফাইটের দণ্ডে লেসার রশ্মি ফেলা হয় পরিকল্পিতভাবে। যে গঠন বেরিয়ে আসে তারা তিরিশ থেকে সত্তর শতাংশ কার্বন ন্যানোটিউব।বাকিটা নেহাৎই গুঁড়ো অসংগঠিত কার্বন কণা। বিভিন্ন পদ্ধতিতে গঠিত হওয়ার সময় কার্বন ন্যানোটিউব সমতলের সঙ্গে কত কোণে গোল পাকায় তার উপর নির্ভর করে তার তড়িৎ সংক্রান্ত ধর্ম। এই কোণের উপর নির্ভর করে সে পরিবাহী না অর্ধ পরিবাহীর মতো আচরন করে। উধাহরণ---রুপা, তামা, লোহা ইত্যাদি। অর্ধপরিবাহী তারাই যাদের তড়িৎ পরিবহনের ক্ষমতা পরিবাহী এবং কুপরিবাহীর মাঝামাঝি। তবে শুধু এটুকু বললেই অর্ধপরিবাহীকে বোঝা যায় না। তাদের অন্যান্য বিশেষ ধর্মও আছে। বালির মধ্যে পাওয়া যায় যে সিলিকন তা অর্ধপরিবাহীর সবথেকে ভাল উধহরণ। আরও একটা বহু ব্যবহৃত অর্ধপরিবাহী পদার্থ হল জার্মেনিয়াম।
ন্যানোটিউব অতি ক্ষুদ্র পরিসরের প্রযুক্তি। তাই সেখানে সব সময়ই আগ্রহ কত ছোট জিনিস তৈরি করা যায়। এখনও পর্যন্ত সব থেকে ছোট যে কার্বন ন্যানোটিউব তৈরি করা গেছে তার কৃতিত্ব জাপানের এন. ই. সি-র.। সে কার্বন নলের ব্যাস দশমিক চার(০.৪) ন্যানোমিটার। তাত্বিকভাবে মানে অঙ্ক কষে বলা হয়েছে, এর থেকে ছোট ন্যানোটিউব আর সম্ভব নয়। হংকং ইউনিভারসিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিও এই কৃতিত্বের ভাগীদার।
এখানে একটা কথা বলে দেওয়া প্রয়োজন। ন্যানোটিউব শুধু যে কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি হয়, তা নয়। আরও অনেক পদার্থ থেকে ন্যানোটিউব তৈরি করা যায়। ব্যবহার করা যেতে পারে সিলিকন, গ্যালিয়াম আর্সেনাইড এবং ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড। কার্বনের সঙ্গে অন্যান্য ধাতুর পরমাণু মিশিয়েও ন্যানোটিউব তৈরি করা সম্ভব। অন্যান্য পদার্থ যেমন অ্যালুমিনিয়াম থেকে ন্যানোটিউব তৈরি করা যায় কিনা তা নিয়েও গবেষণা চলছে। হঠাৎ অ্যালুমিনিয়াম কেন আসলে এই ধাতু তুলনায় হাল্কা অথচ অনেক শক্ত। তবে ন্যানোটিউব অথবা ন্যনোতত্ব কীভাবে আচরণ করবে তা দেখায় আগ্রহ রয়েছে সকলের।
কার্বন ন্যানোটিউব কি ? কীভাবে তৈরি হয় ?
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 20, 2018
Rating:
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 20, 2018
Rating:

No comments: