Results for Bondhu

জল কামান খাওয়া এক প্রাথমিক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা

June 27, 2019
দিনটা ২৪ শে জুন ২০১৯ । আগের দিন রাত্রে এক ভাই ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলো - " দাদা , কাল আমরা শেষ কামড় বসাতে যাবো , তুমি আসবে তো ? " 
হেঁসে বললাম - কাকে আবার কামড়াতে যাবি ভাই ? ভেউ ভেউ করে দুর্নাম করেছিস , এবার কি কামড়ে জলাতঙ্ক করে ছাড়বি ? "
পরের দিন যে এভাবে আমার মুখের কথা জল-আতঙ্কের রূপ নেবে ভাবতে পারিনি । 
যাইহোক - কিছু হাসি ঠাট্টা করার পর বললাম - মায়ের অসুখ , আন্দোলনে যেতে পারবো না । ভাইটা আর কিচ্ছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে দিল । 
রাত তখন ৯ টা হবে ,প্রতিদিন এই সময়ে পাশের বাড়ির মেয়েটি বেশ চিৎকার করে পড়াশুনা করে । কোনো কোনো দিন ওর পড়া কানে আসে । শুনতে বেশ লাগে । পাড়ায় দু'এক জন নতুন সঙ্গীত শিল্পীও হয়েছে  , তাদের বেসুরো গানের চেয়ে পড়ার আওয়াজ বেশ মধুর । সেদিনও মন গেল , কি পড়ছে শুনতে পেলাম ।
 সিপাহী বিদ্রোহের কারন ও ফলাফল । 
 আশ্চর্য , হঠাত মনে হল - কালকের আন্দোলনটা কি সিপাহী বিদ্রোহের থেকে কোনো অংশে কম ? মনের মধ্যে এক আলাদা ভাবের সঞ্চার হল । এই আন্দোলন কি একরকম স্বাধীনতার আন্দোলন নয় ? - স্বল্প বেতনের লজ্জা থেকে স্বাধিনতা , মানুষের হাজারো বাঁকা প্রশ্নের থেকে স্বাধীনতা , মন খুলে বাঁচতে না পারার জ্বালা থেকে স্বাধীনতা । 
সিপাহী বিদ্রোহ একটি চরম অসফল বিদ্রোহ , ইংরেজদের কাছে গো হারা হেরেছিল সিপাহীরা । এমনকি মঙ্গল পান্ডে আত্মহত্যা করতে গেছিলেন । তবু আমরা স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রামের কথা ভাবলেই এই বিদ্রোহের কথাই আগে মনে করি । এই বিদ্রোহ যেমন স্ফুলিঙ্গ ছিল পরবর্তী হাজারো সংগ্রামের , তেমনই হয়তো কালকের সংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে । 

আর আমি  স্কুলে বসে হটস্টার চালিয়ে লাইভ টিভিতে দেখবো - আন্দোলনের কি পরিস্থিতি ? 
ভাবলাম , আমি কি এতটাই সঙ্কীর্ণ ? 

মন আর মানলনা । ঠিক করলাম যাবই , দেখি কি হয় - 


পরদিন সকাল আট'টার ট্রেন ধরবো ঠিক করেও পারলাম না । পরের ট্রেন সকাল ন'টায় । তাই হোক । বেড়িয়ে পড়লাম , কি হবে জানিনা তাই আলাদা কোনো প্রস্তুতিও নিইনি । জল , ছাতা , মানিব্যাগ , আই কার্ড আর ট্রেনে বসে পড়ার জন্য ব্রাইয়ান ট্রেসির বই ' মাস্টার ইওর টাইম , মাস্টার ইওর লাইফ ' নিয়ে  নিলাম। 
শিয়ালদহ পৌঁছে জানতে পারলাম - সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে যেতে হবে । ওখান থেকেই যাত্রা শুরু হবে । হয়তো শেষ হবে ধর্মতলায় রানী রাসমনী রোডে । উত্তেজনায় টগবগ করছে শরীর । কদিন আগেই একটা স্মার্ট ওয়াচ কিনেছিলাম । ঘড়িটাতে সময় ছাড়াও দিনে কত কিমি হাটলাম , হার্ট রেট কত - এরকম অনেক কিছু দেখা যায় । আন্দোলনে হাঁটতে হবে বলে স্মার্ট ওয়াচ পড়েই এসেছিলাম । শিয়ালদহ থেকে কিছুক্ষন হেটে পৌছালাম সুবোধ মল্লিক স্কয়ার-এ । দেখি কয়েক হাজার শিক্ষক রাস্তা জুড়ে দাড়িয়ে আছেন । পিছনের দিকের কয়েকজন চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খেয়ে নিচ্ছেন । অনেকে হাততালি দিয়ে জোড়ে জোড়ে - " পি.আর.টি ,  পি.আর.টি   " বলে চিৎকার করছে । বেশ একটা দুর্গাপুজার মতো পরিবেশ । শুনতে পেলাম টুপি আর ব্যাচ সামনে গেলে পাওয়া যাবে । কয়েক হাজার মানুষকে পাশ কাটিয়ে সামনে গেলাম । ভিড়ের এক্কেবারে সামনে ক্যামেরা হাতে কয়েকজনকে দেখলাম । আর দেখলাম " ইউইউপিটিএ "এর  এক একটি অক্ষর হাতে নিয়ে দারিয়ে আছেন দিদি মনি ও মাস্টারমশাইরা । ব্যাচ পেলাম , সেফটিপিনও; কিন্ত টুপি নেই ।  
এবার পালা চেনাজানা মুখ খোজার । লাইনের শেষ মাথা আর দেখা যায়না । তারই মধ্যে কিভাবে যেন জনা চারেক অতিপরিচিত শিক্ষকমশাইদের পেয়ে গেলাম । কিছুক্ষন অপেক্ষার পর বড় ব্যানার এল । দুটি ম্যাটাডো গাড়িও এলো , নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন তারা গাড়িতে করে রওনা দিলেন , তাদের হাতে মাইক্রোফোন । গাড়ির মাথায় লাগানো মাইক । কাছ থেকে দেখেছিলাম তাই বলতে পারি - নেতৃত্ব প্রদানকারী শিক্ষকদের কয়েকজনের শরীর বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া গাছের মত হলেও তাদের উদ্যম এক আলাদা স্পার্কের জোগান দিচ্ছিল আমাদের মধ্যে । ১২ টা নাগাদ শুরু হল মিছিল । দুটি লাইন , রাস্তার দু'পাশ দিয়ে হাটা শুরু , সবাই এখানে শিক্ষক বা শিক্ষিকা । হাঁটতে হাঁটতে চলতে লাগলো স্লোগান - " আমরা কারা ? উস্থিয়ান, সামনে কারা - উস্থিয়ান ..." তারপর - " আমরা কি চাই ? পি.আর.টি ... " আরো অনেক কিছু । চলতে চলতে দেখা পাওয়া গেল সার বেধে দাড়ানো কলকাতা পুলিশের । তারা হাসি হাসি মুখ নিয়ে দাড়িয়ে দেখছিল মিছিলের চলমানতা । পুলিশের সামনে দাড়িয়ে গেলেন একদল শিক্ষক , হাতের তালির সাথে সাথে স্লোগান উঠলো - " পুলিশ তোমার ডি.এ বাকি , এই মিছিলে হাটবে নাকি ?"  
দু একজন পুলিশ মুখে এক অসহায় হাসি মেখে আমাদের এগিয়ে যেতে বললেন । আবার সচল হল মিছিল । পৌছালাম ধর্মতলা । নেতৃত্ব থেকে চুপি চুপি বলে গেল - " যতটা পারবেন আস্তে হাটবেন , ঘন্টা খানেক যানচলাচল অচল না হলে আমাদের খবর মিডিয়া নেবে না " । বুঝলাম তো, কিন্তু কত আর আস্তে হাঁটা যায় ? হাঁটতে হাঁটতে চোখ গেল আটকে থাকা গাড়িগুলোর দিকে । বাস , ট্যাক্সি , প্রাইভেট গাড়ি সব সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে । কেন জানিনা , বড় মায়া হল । ভাবলাম - আমরা যখন বাসে থাকি আর সামনে দিয়ে মিছিল যায় , তখন মনে হয় - কখন শেষ হবে ? ।  জানি , অনেক মানুষ ভয়ঙ্কর ব্যাস্ততা নিয়ে বেড়িয়েছেন । তারা হয়ত হা পিত্যেশ করছেন , হয়তো ভগবানের কাছে চাইছেন - এই জ্যাম তাড়াতাড়ি ঠিক করানোর জন্য । আবার এও মনে হল - ওই বাসে যারা বসে আছেন তাদের মধ্যেও হয়ত কেউ প্রাইমারী শিক্ষক বা কোনো শিক্ষকের স্ত্রী বা সন্তান বা পরিবারের কেউ । এই আন্দোলন তাদের জন্যেও । 
জানিনা মিছিলের আর কতক্ষন লেগেছিল রাস্তা পার হতে , তবে দুপুর ১ টা ১৫ নাগাদ আমরা জড়ো হলাম রানী রাসমনী রোডে । সামনের রাস্তা ঘিরে রেখেছে পুলিশ বাহিনী , প্রথমে একটা ব্যারিকেট , তারপর আরো উচু আরেকটি ব্যারিকেট । কথায় কাজ না হলে এই ব্যারিকেট ভাঙতে হবে । এটাই নাকি নিয়ম । এই দুটি ব্যারিকেট ভাঙতে পারলেই আমরা যেতে পারবো বিধানসভা , তারপর নবান্ন । 
ও , এতো অনেক কাজ । শরীরে শক্তির টান পড়েছে তাই পাশের একটি হোটেলে ঢুকে কয়েকটা নান খেয়ে নিলাম । হোটেলের মালিক জিজ্ঞাসা করলেন - " দাদা , এই " পি.আর.টি কি জিনিস ? সবাই দেখছি চাইছেন আপনারা " , বুঝলাম - সাধারন মানুষ অনেকেই আমাদের আন্দোলনের কারন বুঝতে পারেননি । একটু ভেঙ্গে বোঝালাম । ভদ্রলোক বললেন - " আরে দাদা , আপনারা কি পাগল হয়েছেন ? এ সরকার আর থাকবে না , এ শেষ সময়ে লুটেপুটে নিয়ে যাবে । আপনাদের কিচ্ছু দেবে না ।" 
কিছু বললাম না । আমরা রাজনীতি করতে আসিনি । কোনো রঙ নিয়েও আসিনি । শুধুই কয়েকটি দাবি নিয়ে এসেছি । সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দুই'লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের মনের কথা সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র । এভাবেই তো পরিবর্তন আসে । 


খেয়েদেয়ে শক্তি পেলাম । জড়ো হলাম ব্যারিকেটের কাছে । শুনলাম আমাদের নেতৃত্বদের মধ্যে ৫০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন । কাজেই আর বসে থাকা নয় । ধাক্কা মারো ব্যারিকেটে । 


শুরু তো হল ধাক্কা মারা , কিন্তু লোক কই ? আমরা জনা শ'তেক লোক গায়ের জোড়ে ধাক্কা মেরে চলেছি দড়ি বাঁধা পুলিশ ব্যারিকেটে । উল্টদিক থেকে প্রায় সম সংখ্যক পুলিশ একই তালে উল্টধাক্কা মেরে আটকে রাখছেন ব্যারিকেট । এ যেন  পুলিশ আর শিক্ষকের  - " দোল দোল দুলুনি খেলা " । আস্তে আস্তে যোগ দেওয়া শুরু করলেন আরো শিক্ষক শিক্ষিকা রা । মনে বল পেলাম । শুরু হল অন্তহীন ঠেলাঠেলি । বোঝা গেল - পুলিশের দম ফুরাতে শুরু করেছে । তাই - রেডি করা হল জল কামান । আগে শুধু টিভিতেই দেখেছি তাই বুঝিনি এর কি ক্ষমতা । ঝড়ের বেগে একরাশ জলরাশি  এসে লাগলো বুকের ছাতিতে । পিছিয়ে গেলাম কয়েক হাত । মনে পড়লো , পকেটে আছে কিস্তিতে কেনা ১৩ হাজারের ফোন । পিছিয়ে এলাম বেশ কিছুটা । তখনো জল কামান চলছে পুরোদমে । মোবাইলটাকে ব্যাগে ভরে , ব্যাগটাকে প্লাস্টিকে মুড়ে রেডি হয়ে আবার এগিয়ে গেলাম । নোংরা জলের স্রোত এসে লাগলো কানে , বুঝতে না বুঝতেই আবার , তারপর আবার । অন্য কেউ হলে হয়ত বিরত্ব দেখাতো কিন্তু আমি এক মাস্টারমশাইয়ের ছাতার তলায় গিয়ে কোনোরকমে নিজেকে বাঁচানোর চেস্টা করতে লাগলাম । ছাতার সাথে লড়াই করে জলের তোড় ভিন্ন পথ নিল । এবার শুরু হল হাটু আর মুখে আক্রমন । কিছুক্ষনের জন্য জলের ভয়ে কুকড়ে গেছিলাম । তারপর স্রোত থামল । জল শেষ । রিফিল করতে মিনিট দশেক লাগবে । দেখলাম - বুকের ব্যাচ কোথায় যেন ছিড়ে পড়েছে , জামা , জিন্স , পিঠের ব্যাগ সব ভিজে চুপচুপ করছে । মনে বেশ একটা কষ্ট লাগলো , আমরা প্রাইমারীর মাস্টাররা কি এতটাই অপ্রয়োজনীয় ? এতটাই হেয় ? ন্যায্য দাবির কথা বলায় - গ্রেফতার , জল কামান ? কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছিল । আরো আশ্চর্য লাগছিল পিছনের কয়েক হাজার শিক্ষকদের দেখে । আমরা খাচ্ছি জল কামান , তাঁরা খাচ্ছেন - চা , সরবত , আখের রস । ভেজা জামাকাপড়েই পিছনের দিকে ছুটে গেলাম - সামনে যাদের পেলাম তাদের বললাম - " আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে আসুন , সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়ি " । তাঁরা অনেকেই আমার ছবি তুলে নিলেন । কয়েকজন পরিস্কার ভাষায় বললেন - " তোমরা লড়  আমরা সাথে আছি ।  বুঝলাম না " এ কেমন সাথে থাকা !!! রাগে শরীরে এনার্জি বেড়ে গেল । আবার গেলাম - ঠেলাঠেলি শুরু । আবার জলকামান শুরু । এবার আর পিছিয়ে আসিনি । বুদ্ধি করে সবাই মিলে ব্যারিকেট না ঠেলে দিলাম এক টান । ব্যাস , আমাদের দিকেই ভেঙ্গে পড়লো ব্যারিকেট । হুড়মুড়িয়ে ব্যারিকেটের উপর উঠতেই টের পেলাম এক মাস্টারমশাইয়ের পা চাপা পড়েছে লোহার ভারী ব্যারিকেটের তলায় । লাফ দিয়ে নেমে গেলাম ।  সামনে আরো বড় ব্যারিকেট  । পিছন ফিরে দেখলাম আহত শিক্ষককে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । মাস্টারমশাইয়ের চোট কেমন তা দেখার আগেই জল কামান এসে লাগলো গলার কাছে । ছুটে একপাশে চলে গেলাম । সরে গেলাম অনেকটা কোনার দিক , কামানের নাগালের বাইরে । কিছুক্ষন চালিয়ে আবার একটু বিরতি । এই মোক্ষম সময় দ্বিতীয় ব্যারিকেট ভাঙার । 


কিন্তু হায় !! এই ব্যারিকেটের ইঞ্জিনিয়ার পরীক্ষায় ফাঁকি মেরে পাশ করেনি । মজবুত ব্যারিকেট । ব্যারিকেটে ধাক্কা মারতে গেলে পাদানীতে চড়তে হচ্ছে , আর পাদানীটা ব্যারিকেটের-ই অংশ । একেই শক্ত স্টিলের ভার , তার উপরে নিজের ওজন , অন্যপাশে পুলিশ বাবাজীরা যুত করে ব্যারিকেটের পাদানির উপর উঠে বসে আছেন । এ ব্যারিকেট ভাঙতে ক্রেন প্রয়োজন । এমনিতেই শক্তি শেষ , তার উপরে ক্রমাগত জল কামান । এই যুদ্ধও চলল ৩০ মিনিট মত । আর পারছিলাম না । শুকনো ড্রেসের শিক্ষকেরা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । সত্যি বলতে কি ভীষণ রাগ আর হিংসা হচ্ছিল । মনে হচ্ছিল - আমরা এই হাজার খানেক লোক পাগল , আর বাকি সবাই পাগলা গারদে এসেছেন পাগল দেখতে । 


যাইহোক , ব্যারিকেট যুদ্ধে আমাদের অবশ্যম্ভাবী হার যখন মনের ভিতরে জায়গা গেঁড়ে বসেছে তখন খবর পেলাম - " শিক্ষা মন্ত্রী কথা বলতে রাজি হয়েছেন । সুরাহা হবে " । ৩০ মিনিট রেস্ট । উঠে পরলাম । মাথা ঝিম ঝিম করছিল । গা হাত পা কাঁপছিল । এদিক ওদিক খুঁজে গতকালের ভাইটির দেখা পেলাম । তার জিন্স কিছুটা ভিজেছে । জলের ছিটে লেগেছে বোধ হয় । আমার সাথে কয়েকটা ছবি তুলে বলল - " দাদা , আমার কাছে গামছা আছে তুমি গা হাত পা মুছে এক সেট নতুন জামা প্যান্ট পড়ে নাও । " 
বললাম জামা প্যান্ট কোথায় পাবো ? এমন হবে তা তো জানতুম না তাই কিছুই এক্সট্রা আনিনি । 
কাজেই - ধর্মতলা বাজার থেকে একটা নতুন প্যান্ট আর গোল গলা গেঞ্জি কিনে পড়ে ফেললাম । পাশের হোটেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম । তারপর ফিরত গিয়ে দেখি সব শান্ত । জল কামান আর নেই , সবাই পেপার পেতে বসে শুয়ে আছেন । মাইকে একজন শিক্ষক গান গাইছেন । এভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময় । একজন বিজ্ঞ ব্যাক্তি এসে বললেন - " খবর পেলাম এই অবস্থান বিক্ষোভ না তুললে , গ্রেফতার হওয়া ৫০ জন শিক্ষকদের ছাড়া হবে না  " । 
গভীর এক হতাশা মন টাকে গ্রাস করে নিল । মাথা আর কান ততক্ষনে ব্যাথার চরম সীমায় পৌঁছে গেছিল । আর ওখানে বসে থাকতে পারলাম না । ভেজা বই ,আধ ভেজা মোবাইল আর ভেজা মানিব্যাগ ভরা ভেজা ব্যাগটাকে  কাঁধে নিয়ে উঠে পরলাম শিয়ালদহ যাওয়ার বাসে । মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম - আরে আর কিছু হোক না হোক - এটুকু তো নিশ্চিত হলাম যে আমার স্মার্ট ওয়াচটি সম্পূর্ণ ওয়াটার প্রুফ । 


[ আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম - এক প্রাথমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ]

***ভালো লাগলে লেখাটি শেয়ার করতে পারেন 
জল কামান খাওয়া এক প্রাথমিক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা  জল কামান খাওয়া এক প্রাথমিক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা Reviewed by Wisdom Apps on June 27, 2019 Rating: 5

জন্মদিন - পার্থ চক্রবর্তী

June 10, 2019

বাড়িতে মা ষষ্ঠীর পুজোটা বেশ যত্ন নিয়েই করেন সুচতনা দেবী। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই শাশুড়ি মা বলেছিলেন জামাইষষ্ঠীর দিনে অরন্যষষ্ঠীর ভক্তিভরে পুজো করলে পরিবারের ধন সম্পদ সুখ শান্তি অক্ষয় হয়। ছেলেপুলেদের জীবনও অক্ষয় হয়। সেই দিন আর নেই। শাশুড়িও নেই, আর সুখ শান্তিও অক্ষয় হয়নি সুচেতনার। বিয়ের ৪ বছরের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন। সেই শোকেই অল্পদিনের মধ্যেই গেলেন শাশুড়ি। ছোট্ট রঞ্জুকে বুকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমেছিলেন তিনি। স্বামীর অফিসের চাকরিটা পেয়ে একটা ভরসা পেয়েছিলেন বুকে। আজ তিনি অবসরের দ্বারপ্রান্তে। ছোট্ট রঞ্জু আজ সরকারী অফিসার। ছেলেটা হয়েছে খুব প্রানবন্ত। চাকরির ফাঁকেই নাটক, বেড়ানো,সমাজসেবা,রক্তদান,গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্যাম্প করা সারাদিন শুধু দৌড় আর দৌড়। এবার বাঁধতে হবে ওকে। সংসারের দায়িত্বে জুতে দিতে হবে। আজও কোথায় বেরিয়েছে বাইক নিয়ে। ঠাকুরের সামনে বসে বসে ষষ্ঠীপুজোর যোগাড় করতে করতে এইসবই ভাবছিলেন সুচেতনা। প্রার্থনা করছিলেন ওকে ভালো রেখো ঠাকুর। ছেলের হাতে বাঁধার জন্য হলুদ সুতোয় দূর্বা বাঁধছিলেন। মা ষষ্ঠীর রক্ষাকবচ।

টিংটং,টিংটং করে ব্যস্তভাবে বেল বাজাল কে। রঞ্জু এলো? বাইকের আওয়াজ তো পেলামনা। দরজা খুলতেই দেখেন রঞ্জুর বন্ধু সাগর,প্রবাল,শান্তশ্রী দাঁড়িয়ে আছে।"মাসিমা রঞ্জুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। বাইকে আসছিল, লরিতে ধাক্কা মেরেছে। ছিটকে পড়েছে রাস্তার ধারে। পাথরে মাথা ঠুকে গেছে সজোরে। হেলমেট ছিটকে গেছে। সেন্স নেই। আমরা লোকাল নার্সিংহোমে নিয়ে গেছিলাম। বলেছে এখানে হবেনা। ব্রেনে হেমারেজ হচ্ছে, জলদি বড় হাসপাতালে নিতে হবে।" মুহূর্তে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে সুচেতনার। শরীর অবসন্ন হয়ে আসে। কোনোমতে দরজাটা ধরে সামলান নিজেকে। ওরা তাড়া দেয়, সময় খুব কম। টাকা পয়সা ঘরে যা আছে নিয়ে নিন।আর হেলথ কার্ড কিছু থাকলে নেবেন। আর রিলেটিভদের খবর দেবার থাকলে দিন, আমরা ভাবছি জীবনদান হসপিটালে নিয়ে যাবো। লোকাল নার্সিংহোম বলল ওদের ব্যবস্থাই সবচেয়ে উন্নত। এরপর আপনার ডিসিশান।
দ্রুত হাতে টাকা পয়সা, হেলথ কার্ড ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পরেন তিনি। বন্ধুরা খুবই করেছে। নিজেদের উদ্যোগেই ট্রমা কেয়ার এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে। গিয়ে দেখলেন ছেলে তাঁর ঘুমিয়ে আছে। চোট আঘাত কিচ্ছু বোঝাই যাচ্ছেনা। তারপর সারারাত ভেন্টিলেশন, ডাক্তারদের তৎপরতা, যমে মানুষে টানাটানি। উৎকণ্ঠায় রাত্রি জাগরন।সমানে নারায়নকে ডেকেছেন। সকাল ৮টার দিকে খবর এলো বিজ্ঞান, এতো চেষ্টা, ঠাকুরকে ডাকা সব ব্যর্থ হয়েছে। ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে রঞ্জুর। সুইচ টিপলে যেমন মুহূর্তে ঘরটা অন্ধকার হয়ে যায়,সেইভাবেই মুহূর্তে সারা পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো তাঁর সামনে।অজ্ঞান অবস্থায় কতোক্ষন ছিলেন জানা নেই। যখন জ্ঞান ফিরল কয়েকজন আত্মীয় আর রঞ্জুর বন্ধুদের উৎকণ্ঠিত মুখ দেখতে পেলেন। কিছুটা সামলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন।জল খেলেন একটু। একটু পর একজন আস্তে করে বলল, মাসিমা ডাক্তাররা জিজ্ঞাসা করছেন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম কি খুলে দেবেন? বাড়ির লোকের পারমিশান চাই। অসহায় ভাবে কী যেন খুঁজলেন চারদিকে। তারপর বললেন, আরেক ঘণ্টা থাকুক। যদি ফিরে আসে। আবার চোখ বুজলেন। এতদিন ঝড় ঝাপটা সহ্য করে জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা মানুষটা বসে রইলেন বজ্রাহতের মতো। শোক দুঃখ চিন্তার বাইরে শুধুই অবসন্নতা শরীর মন জুড়ে।
একটা ফুঁপিয়ে কান্নার অস্ফুট শব্দে চোখ মেললেন তিনি। দেখতে পেলেন আর এক বজ্রাহত মানুষকে। মোটা ফ্রেমের চশমা আর ধুতি পাঞ্জাবীর উসকোখুসকো চেহারার বছর ৬০ এর এক ভদ্রলোক। ধপ করে বসে পড়লেন পাশের চেয়ারে। পাশে তাঁর স্ত্রীই হবে। তিনিও ভেঙে পড়েছেন খুব। আরেকটি ছেলে উঠে এসে বলল, কি বললেন ডাক্তার বাবু? বৃদ্ধ নিজেকে একটু সামলালেন, তার পর বললেন মামনির লিভার একদম নষ্ট। রিকভার করার কোনও উপায় নেই। একমাত্র উপায় কারোর লিভার যদি পাওয়া যায়। কিন্তু ডাক্তার বাবু বললেন লিভার পাওয়া খুব শক্ত। কিডনি দুটো থাকে, অনেকে একটা দিতে রাজি হয়। কিন্তু লিভার পেতে গেলে সদ্যমৃত কারোর থেকে নিতে হবে। একটু দেরি হলেই নষ্ট হয়ে যায়। এদেশে নাকি খুব কম মানুষ দেহ বা অঙ্গ দান করে।মেয়ের আয়ু আর মাস খানেক বড়জোর। ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভদ্রলোক।
শুনতে শুনতে আবার অবসন্নতায় ডুবে গেলেন সুচেতনা। মাথাটা কাত হয়ে গেলো। হঠাৎ ডাক মা মা। ধড়মড়িয়ে উঠলেন সুচেতনা। রঞ্জুর ডাক। আমি একটু বেরচ্ছি। এই যাস না, যাস না। কিছু খেয়ে যা। না মা, তাড়া আছে। বাচ্চুর ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। রক্ত লাগবে। ও পজেটিভ, আমার গ্রুপ। শোন শোন, এই তো ২ মাস আগে দিলি। এখন তো আর দেওয়া যাবে না। আমার কথা শোন। একটু নিয়ম মান। আমার দিব্যি দিচ্ছি যাস না। দাঁড়িয়ে যায় রঞ্জু। দেখো মা। রক্ত দিলে আবার রক্ত হবে। ভাবো মা, সবাই বাইরে থেকে উপকার করছে। আর আমি ওর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, রক্তে মিশছি, শিরায় শিরায় বইছি। বাচ্চুর ভাইয়ের শরীরে তোমার ছেলে। ও ভালো হোক, একদিন আনবো ওকে। ছুঁয়ে ফিলিং হবে, তোমার আরেকটা ছেলে বাড়ল। আসলে কি জানো তো মা, যত টাকাই থাকুক, রক্ত কৃত্রিম ভাবে কিছুতেই বানানো যাবে না। আমরা সুস্থ সবল মানুষেরা যদি ফ্রেশ রক্ত না দিই, কারা দেবে মা? যেতে দাও প্লিজ। বয়ে যাই ওর শিরায় শিরায়।যা বাবা, বাঁচা অন্যের প্রান।
আবার চেতনা ফিরল সুচেতনার। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। রঞ্জু কোথায়? তিনি তো হাসপাতালে। মনে পড়লো সবটা।রঞ্জুর সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেলো আবার। রঞ্জুর এক বন্ধুকে বললেন, পাশের ওই ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? বন্ধুটি বলল, তারা তো বেরিয়ে গেছে। চট করে বাইরে যা বাবা, খুঁজে আন। না, বাইরেও পাওয়া গেলো না। হাল ছাড়লেন না সুচেতনা। রঞ্জুকে বাঁচানোর সুযোগ ছাড়বেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, ঠিকানা জোগাড় করলেন। লিভার সমস্যা নিয়ে ভর্তির তথ্য ঘেঁটে ওরা খোঁজ দিলো সেই পরিবারের। ডাকা হল তাদের। রঞ্জুর লিভার দান করবেন। ডাক্তাররা দেখবে এই লিভারে কাজ হবে কিনা। এই মেয়েটির না হলে অন্য কারোর হবে। ডাক্তার বাবুরা ছুটে এলেন অঙ্গ দানের খবর পেয়ে।মা দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের অঙ্গ দান করতে চাইছে এখনও এখানে তা বিরল নিদর্শন। খবর গেলো মিডিয়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে কিডনি, হার্ট, লিভার, চোখ এমনকি স্কিন পর্যন্ত দান করলেন তিনি।
এই প্রথম তাঁর বাড়িতে ষষ্ঠীপুজো নেই। সকাল থেকে খালি চোখ ভিজে যাচ্ছে তাঁর। আগের বছর এই দিনেই রঞ্জু চলে গেছিলো। কি নিষ্ঠুর পরিহাস। ছেলের মঙ্গল কামনায় যে পুজো করতেন, সেই পুজোর দিনেই চলে গেলো ছেলেটা।আজ শুধুই শূন্যতা। টিংটং বেল বাজলো।দরজা খুলতেই একে এক করে ঘরে ঢুকল মামনি,রাজা,সংকল্প,আদিত্য, আয়েশা,রবিন্দর,ঝুমুর। একসঙ্গে সবাই জড়িয়ে ধরল তাকে। সবার হাতে রজনীগন্ধার মালা। রঞ্জুর ছবিটাকে ফুলে ফুলে ঢেকে দিলো। আবার চোখ ভিজল তার। এগিয়ে এলো সংকল্প। আমার চোখের দিকে তাকাও মা, দেখো তোমার সঞ্জুর চোখ।সঞ্জুই তোমায় দেখছে।আয়েশা বলল আমার বুকে কান পাতো মা, রঞ্জু ধুকধুক করছে।সারাক্ষন আমার ভেতর থেকে কথা বলে আমার সঙ্গে। ওই রবিকে টাচ করো তোমার ছেলের স্পর্শ পাবে।আমাদের সবার মধ্যে তোমার ছেলে বেঁচে আছে।
ভেতর ঘরে যান সুচেতনা। একটা ভালো শাড়ি পরে বাইরে আসেন। সবাইকে বলেন যা মিষ্টি, মাংস,পনীর নিয়ে আয়। আজ রঞ্জুর জন্মদিন। এই দিনে যেমন ও চলে গেল, তেমনি এই দিনেই তো ও নতুন করে জন্ম নিয়েছিল তোদের সবার শরীরে। আজ কতো আনন্দের দিন। খুব আনন্দ করবো সারাদিন। সারাদিন হাসি গল্পে গানে আনন্দে কাটল। সকলের হাতে সুচেতনা বেঁধে দিলেন হলুদ সুতো। সবাই সংকল্প করবো রঞ্জুর মতোই তারাও অঙ্গীকার করবে অঙ্গদানের। বেঁচে থাকবে মানুষের মধ্যে। দেবতারা অমরত্ব দিতে না পারলেও অমর হবার চাবিকাঠি নিজেদেরই হাতে। মালায় ঢাকা রঞ্জুর ছবিটা ঝলমল করে উঠছিল অমরত্বের গর্বে। বার্তা দিয়ে গেলো অঙ্গ দান, মহৎ দান।
,,,,,,,,
জন্মদিন - পার্থ চক্রবর্তী জন্মদিন - পার্থ চক্রবর্তী Reviewed by Wisdom Apps on June 10, 2019 Rating: 5

ইতি কথা - কলমেঃ রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী

June 08, 2019

"ওমা সকাল সকাল আবার প্রণাম কেন বাপু?"

নতুন বৌ স্নিগ্ধা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে গা ঢাকতে ঢাকতে বলে," আসলে মা আজ আমার জন্মদিন তো তাই। এটাই অভ্যেস হয়ে গেছে আমার,ও বাড়িতে থাকতে মা বাবাকে ঘুম থেকে উঠেই প্রণাম করতাম।"
একটু ছোট হাই তুলে ওর শাশুড়িমা ঊষা বলেছিলেন," তা ভালো থেকো,মানিয়ে গুছিয়ে সংসার কোরো। সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক,শত পুত্রের জননী হও।"
মায়ের আশীর্বাদ শুনে নতুন বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো শুভময়। একটু হেসে মাথা নিচু করেছিলো ও।
..." তা শুভ বলেনি তোমাকে আমাদের বাড়িতে মেয়ে বৌদের জন্মদিন টিন হয়না। শুধু ঐ ছেলেদের জন্মদিনে একটু পায়েস মিষ্টি খাওয়াই ঐটুকুই।
সেদিনের একুশের স্নিগ্ধা তারপর এই বাড়িতে শাশুড়িমায়ের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো বছর। প্রতিবারই যদিও জন্মদিনের দিন একটা প্রণাম করে শাশুড়িকে কিন্তু প্রথম বছরেই জেনে গিয়েছিলো এ বাড়িতে মেয়ে বৌদের জন্মদিন পালন হয়না।
প্রথম দুএকটা বছর খুবই খারাপ লেগেছিলো কারণ বাপের বাড়িতে থাকতে মা বেশি কিছু না পারলেও একটু লুচি ছোলার ডাল আলুরদম আর পায়েস দিয়ে ওদের দুই ভাইবোনের জন্মদিনেই খাওয়াতো। কখনও বা হত পোলাও মাংসও,দুএকজন বন্ধুবান্ধবও আসত ওর আর দাদার।
স্নিগ্ধার বাপের বাড়ি দূরে তাই হুট করে সেখানে চলে যাওয়া যেতনা সংসার ফেলে। তখন এত ফোনেরও চল ছিলোনা। তাই চিঠিই ভরসা,বাবার চিঠিটা ঠিক এসে পৌঁছতো সেই দিন বা আগের দিন ,"স্নিগ্ধা মা জন্মদিনের অনে‌ক আশীর্বাদ রইলো। খুব ভালো থাকিস আর সবাইকে ভালো রাখিস।"..কখনোও পাশে মায়ের লেখা দুচারটে শব্দও থাকতো। আবার যদি কখনও ঐ সময় ওখানে থাকতো তাহলে বাড়িটা লুচিভাজার গন্ধ আর মাংসের গন্ধে ম ম করতো। তার সাথে বাবার দেওয়া শাড়ি,দাদার দেওয়া উপহার।
অবশ্য এই বাড়িতে জন্মদিন পালন বারণ থাকলেও শুভময় প্রতিবারই হাতে করে ওর সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু না কিছু এনে স্নিগ্ধাকে বলত," শুভেচ্ছা, শুভকামনা আর ভালোবাসায় ভরা থাক তোমার জীবন।"..ছোট্ট সেন্টের শিশি কখনও বা একটা ভয়েলের শাড়ি অথবা রাতে শোয়ার পোশাক ভালোবাসায় মুড়িয়ে শুভময় তুলে দিত স্নিগ্ধার হাতে আর তার সাথে একগুচ্ছ গোলাপ। হয়ত স্বামীর এইটুকু ছোট ছোট ভালোবাসার ছোঁয়াই জয় করার সাহস দেয় অনেক প্রতিকূলতাকে।
সেদিনের নতুন বৌ স্নিগ্ধা আজ নিজেও সন্তানের মা, তবুও ভালো ওর সন্তানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়। আর হবেই না বা কেন ও তো ছেলে তাই ঘটা করেই জন্মদিন হয় ওর। মাঝে মাঝে মনে হয় স্নিগ্ধার ওরও ছেলে,শাশুড়িরও দুই ছেলে আবার ওর বরের থেকে দশ বছরের ছোট ভাই মানে ওর দেওরেরও ছেলে তাই শাশুড়ির নিয়ম আর কাউকেই ভাঙতে হয়নি। যদিও শুভময়ের খুব শখ ছিলো আরেকটা কেউ আসুক তবুও কম আয়ের জন্য আর ভাইয়ের পড়াশোনার কিছু খরচও চালানোর জন্য আর ভাবা হয়নি।
বরের সাথে নিভৃত আলাপে আর আদরের ফাঁকে স্নিগ্ধা বলতো,"এই ভালো একটাই ছেলে কোন ঝামেলা নেই। মেয়ে হলে বেচারা কষ্ট পেত।"..শুভময় ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলত," মেয়ে হলে আমি জন্মদিন করতামই মাকে ঠিক বুঝিয়ে নিতাম।"..চুপ করে যায় স্নিগ্ধা, হয়ত বুকের সিন্দুকে জমা কথাগুলো ছটফট করে না বলতে পেরে ওখানেই।
স্নিগ্ধার দেওর চাকরি সূত্রে বাইরে থাকে পরিবার নিয়ে। ওরা ওদের নৈহাটির পুরোনো বাড়িতেই থেকে গেছে,বছরে এক বার দেওর জা আসে। কখনও বা কোন দরকারে একা দেওরও চলে আসে। শাশুড়িমার সঙ্গে ওরা থাকলেও ছোটছেলে আর বৌমা ওনার কাছে সেরা। সবার কাছে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন ছোট ছেলের আর বৌমার। স্নিগ্ধার জা হাউসওয়াইফ হলেও উচ্চশিক্ষিতা আর আধুনিকা। যদিও স্নিগ্ধাও বি.এ পাশ,তবে বিয়ের পর সেসব আর কোন কাজে লাগেনি মানে ঐ এপাশ ওপাশ আর ধপাশ। এখন মনে হয় কবে যে কি পড়েছিলো হয়ত আলুপটলের ঝুড়ি গোছাতে গোছাতে ভুলেই গেছে সবই আর ঐগুলোও ছাইপাশ হয়ে গেছে।
ওদের বাড়িটার খুবই দুরবস্থা,পুরোনো আমলের বাড়ি তাই সারানোটা খুব দরকার। কিন্তু বাড়িতে থেকে বাড়ি সারানো মানে ধুলো, ময়লা নানা হ্যাঁপা তারমধ্যে ওর শাশুড়ির আ্যজমা তাই ওনাকে ঐ ধুলোর মধ্যে রেখে..কি করে কি করবে এই নিয়ে ওরা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে। শেষে শুভময়ই ভাইকে বলে মাসদুয়েকের জন্য মাকে ওদের কাছে নিয়ে রাখতে। দাদার এতটাই অবদান সংসারে যে ভাই না বলতে পারেনা যদিও বৌয়ের কাছে বলতে গিয়ে খুবই একচোট শুনলো। " আমি বরাবরই একা থেকেছি আমার মত। তুমি তো জানো সারাদিন আমি ছেলের পেছনে ছুটোছুটি করি এছাড়া উইকএন্ডে আমার পার্টি ক্লাব বন্ধু বান্ধব এসব না করলে একঘেঁয়ে বোরিং লাইফে বাঁচাই মুশকিল।
" মা চিরকালই তো নৈহাটিতেই থেকেছে,একটা অসুবিধায় পড়ে দাদা বলেছে একটু মানিয়ে নিলে কি হবে? বেশি তো নয় মাত্র দুটো মাস।"
মিতা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে বললো," দেখো দুমাসের নামে কতদিন রেখে দেয় এখানে। বেশিদিন হলে আমি কিন্তু.."
শাশুড়ির সাথে এতগুলো বছরের সহাবস্থান স্নিগ্ধার কাছে একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই ওর মনটা ফাঁকা হয়ে গেলো। তাছাড়া উনি সংসারের কাজে সাহাজ্যও করতেন, অবশ্য কথাও শোনাতেন। তবুও ওটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো,একলা বাড়িতে দুজনেই দিনের বেশ অনেকটা সময় দুজনের সঙ্গী হয়ে থাকতো। ছেলে আর বরেরও মন খারাপ। 
ছোটছেলের হাত ধরে এই প্রথমবার ওদের সংসারে পা রাখলেন ঊষা,এর আগে কতবার বলেছে ছেলে কিন্তু আসা হয়নি। কি সুন্দর সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট একদম টিভিতে যেমনটা দেখেন ঠিক তেমনি। সোফায় বসেই ব্যাগটা খুলে বসেছিলেন দাদুভাইয়ের জন্য আনা আমসত্ত্ব,নাড়ু আর মালপোয়া বার করতে।
" মা এগুলো সোফায় রাখবেননা,ইশ্ সব নোংরা হয়ে গেলো,একটু আগেই ঘর মুছে গেলো।"
রান্নাঘরে নিয়ে যত্ন করে ওগুলো খুলে নাতির হাতে দিলেন। তবুও নাতির মুখের হাসিটা উপভোগ করতে পারলেননা। বৌমার গম্ভীর আওয়াজ শুনলেন," এখন পড়াশোনা করো,পরে খাবে।"
ছোটছেলের কাছে এসে বড় বাধো বাধো লাগে ঊষার। একছাদের তলায় পাশাপাশি না থাকলে বোধহয় মানুষকে সবসময় চেনা যায়না।তাই হয়ত তিনিও আলো ভেবে এতদিন আলেয়ার পেছনেই ছুটেছেন। সবসময় অন্যের ভুল ধরতে পটু ঊষার এখানে এসে সবসময়ই মনে হয় এই বোধহয় কিছু ভুল করে ফেললেন। তবুও শুনতে হয়," ইশ্ গামছাটা এখানে রেখেছেন? তোয়ালে আনেননি? উফ্ আমার আর ভালো লাগেনা। সবসময় এত বলা যায়!"
মাঝে কেটে গেছে একমাস,প্রায়দিনই হিসেব করেন ঊষা কবে ফিরে যাবেন নিজের বাড়ি। বড়বৌমার সাথেও ঠোকাঠুকি হত মাঝে মাঝে। তবে কখনও ভয় লাগতোনা,বরং উনিই শুনিয়ে দিতেন দুটো কথা। 
শুভময় বলে," আমাদেরও বড় ফাঁকা লাগছে মা তোমায় ছাড়া,তবে যা অবস্থা তুমি থাকতে পারতেনা। আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধুলোতে। তোমার বৌমা তো সারাদিন বাড়ি থাকে,ওর খুব নাজেহাল অবস্থা।"
এর মাঝেই একদিন ছোট নাতির কাছে শুনলেন বাড়িতে পার্টি আছে।" কিসের পার্টি গো দাদুভাই? তোমার জন্মদিন?"..নাতিকে হাসতে দেখে ঊষাও হাসেন,সত্যি তিনি বুড়ো হচ্ছেন। আরে ওর জন্ম তো ডিসেম্বরে এখন কি? মায়ের ডাকে চলে যেতে যেতে বলে গেলো,"বিকেলেই দেখতে পাবে।"..ঊষা মাংস খাননা,নিজের বাড়িতে থাকার সময় বড়বৌমা আলাদা বাসনে ওনার রান্নাটা করে সরিয়ে রেখে তারপর মাংসের কড়াইয়ে মাংস র়াঁধে। এখানে ওদের এইসব বালাই নেই সবই নাড়াচাড়া,একদিন বলতে গিয়ে কথা শুনেছেন। তাছাড়া ওনাকে ওরা রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয়না। তাই এইসময়টা ঘরেই বসে থাকেন,চোখের বাইরে যা হচ্ছে হোক। রান্নাঘর থেকে মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। দুপুরে খাবার টেবিলে মিতাই বললো," আপনি রাতে কি খাবেন একটু বলে দেবেন রান্নার লোক বিকেলে এলে। আপনি তো আবার মাংস খাবেননা।"
কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন," আজ কেউ আসবে বাড়িতে? কোন অনুষ্ঠান আছে?"
আপনার ছেলে কিছু বলেনি আপনাকে? আমি তো বলেছিলাম বলতে। ইচ্ছে করলে আপনি বিকেলে একটু মঠ থেকে ঘুরে একেবারে সন্ধ্যের পর আসতে পারেন। আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে সন্ধ্যেয়, আজ আমার জন্মদিন।"
ঢোক গিললেন ঊষা,অনেক বছর আগে জেদের বশে স্নিগ্ধাকে যা বলেছিলেন আজ আর সে কথা মুখে বলতে সাহস পেলেননা। শুধু বললেন," নাহ্ আজ আর মঠে যেতে ইচ্ছে করছেনা হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। জন্মদিনের জন্য কিছু তো আনা হয়নি আমার,তুমি এই টাকাটা রাখো। ভালো থেকো,সুখে সংসার কোরো।"
শাশুড়িকে প্রণাম টনাম মানে অত ভক্তি মিতার নেই। মনে মনে বললো তা আর মঠে যাবে কেন এদিকে নজর রাখতে হবেনা?
সারাটা সন্ধে দরজা ভিজিয়ে ঘরেই কাটলো ঊষার। ছেলে অফিস থেকে আসার পর কেক কাটার সময় ছেলেই নিয়ে গেলো,সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। ওদের খাবার পানীয় সব কিছুর মাঝে নিজেকে বড় বেমানান লাগলো ঊষার। খুব ইচ্ছে করলো একটু নৈহাটিতে ফোন করতে,কিন্তু পারলেননা।কি করে বলবেন আজ ছোটবৌমার জন্মদিনের পার্টি চলছে এখানে। 
নৈহাটির বাড়ির কাজ প্রায় শেষ,আর দিন দশেক বাদেই ঊষার যাবার কথা। ছোটছেলেই পৌঁছে দিয়ে আসবে। হঠাৎই দিন চারেকবাদে একটা দুঃসংবাদ আসে স্নিগ্ধার নাকি স্ট্রোক হয়েছে। আপাতত আই সি ইউতে আছে, বড় অসহায় লাগে শুভময়ের গলা। বড় নাতিটাও খুব অস্থির হয়ে আছে। ঊষাও এদিকে বড় অস্থির হয়ে উঠেছেন। " আমাকে নিয়ে চল বাবা নৈহাটিতে,কে জানে ওখানে কি হচ্ছে? আমার কিছু ভালো লাগছেনা।"
..." মা এত অস্থির হয়োনা,দাদা আমাকে বারবার বলেছে কয়েকটা দিন বাদে তোমায় নিয়ে যেতে। এখন ওদের বাড়ির অবস্থা ভালোনা।"
ঊষা বুঝতে পারেন উনার জন্য বাড়িতে ভীষণ অশান্তি। ওনার যাওয়া হচ্ছেনা শুনে ছোটবৌমাও ভালো করে কথা বলেনা। ছেলেকেও কথা শুনতে হচ্ছে। কদিন ভালো করে খেতে পারেননি ঊষা, ঠাকুরের কাছে শুধু বলেছেন আমার ছেলের সংসারটা ভেঙোনা ঠাকুর। মনে প্রাণে মানত করেছেন বড়বৌমার জন্য। অথচ একটা সময় ওর নিন্দা করে আত্মীয়স্বজনের কাছে কত সুখ পেতেন। সবসময় বলতেন," না আছে রূপ আর না আছে গুণ কি দেখে যে ছেলেটা ভুলেছিলো কে জানে?" ছোটছেলে গিয়ে বৌদিকে দেখে এলেও ঊষার যাওয়া হয়নি। স্নিগ্ধা এখন কিছুটা ভালো আছে বাড়িও এসেছে প্রায় দশদিন নার্সিংহোমে থাকার পর,তবে ডাক্তার অনেক কিছু বারণ করেছেন।
মাঝে কেটে গেছে তিনটে মাস ঊষা ফিরছেন অনেক মাস বাদে নিজের বাড়িতে। হয়ত তেমন সাজানো গোছানো নয়,পুরোনো বাড়ি। তবুও বড় আপনার জায়গা এখানে বড়ই শান্তি আর স্বস্তি।বিয়ের পর থেকে এখানেই তো কেটে গেছে এতগুলো বছর।
শুভময় আর নাতি এসে জড়িয়ে ধরে ওনাকে। হয়ত ছোটছেলের মুখেও স্বস্তির হাসি। সবাইকে দেখতে পেলেও ঊষার চোখদুটো আজ স্নিগ্ধাকেই খুঁজছে। তাড়াতাড়ি করে ঘরে আসেন,স্নিগ্ধার শরীরটা বড় ভেঙে গেছে, বাড়ি ঘর গোছাতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমেই বোধহয় এমনটা হয়েছে। উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা,ওর হাতটা এখনও ঠিক চলছেনা। " থাক বৌমা,আয়ুষ্মতী হও সুস্থ হয়ে ওঠো তাড়াতাড়ি। কি যে চিন্তায় ছিলাম আর বোলোনা। যাক্ ঠাকুর রক্ষা করেছেন।"
আজ ঊষার চোখটা সত্যিই ছলছল করছে কথাগুলো বলতে পেরে। স্নিগ্ধারও ভালো লাগছে আসলে শাশুড়িমায়ের সাথে থাকাটা কখন যে অভ্যেস হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওর মা চলে যাওয়ার পর হয়ত বা অবলম্বনও।
অনেকদিন বাদে আবার নিজের ঘর,রান্নাঘর,অভ্যেসের বিছানায় এসে মনটা বড়ই শান্ত ঊষার। খুব ভালো করেই বাড়িঘর সারিয়েছে ওরা। বেশ নতুন নতুন লাগছে সব। নিঃসঙ্কোচে রান্নাঘরে ঢুকলেন অনেকদিন বাদে পছন্দমত কিছু রান্না করলেন। যদিও বড় ছেলে এসে একবার বকুনি দিয়ে গেলো," রান্নার মেয়েটাকে দেখিয়ে দাও ও করবে,তোমার কি দরকার?"
মাঝে কেটে গেছে একটা মাস,স্নিগ্ধা এখন একটু ভালো। " মাকে দেখেছো তুমি,ঘরে বাগানে কোথাও দেখছিনা তো?"..শুভময় তখনও বিছানায় গড়াচ্ছে ছুটির দিনের আলস্যে। " তুমি এত সকালে উঠেছো কেন? হয়ত ফুল তুলতে গিয়ে কারো সাথে কথা বলছে বাইরে। অত ছটফট কোরনা বিশ্রাম নাও।"
বিছানায় শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগেনা স্নিগ্ধার,বাথরুম থেকে একেবারে স্নান করে বেরোয়,অনেকদিনের অভ্যেস এটা। ঘরে ঢোকেন ঊষা। "মা আপনি?"
ওকে হাত দেখিয়ে ঘরে ঢুকে যান। ততক্ষণে স্নিগ্ধার শাড়ি পরা হয়ে গেছে,অনেকদিন বাদে নাইটির বদলে শাড়ি পরলো। শুভময়েরও কেন যেন খুব ভালো লাগলো অনেকদিন বাদে পরিচিত সাজে স্নিগ্ধাকে দেখে।
" বৌমা এদিকে এসো তো দেখি।"
স্নিগ্ধার মাথায় ঠাকুরের ফুলটা ঠেকিয়ে,কপালে ছোঁয়ান ঊষা। "মানত করেছিলাম,তুমি সুস্থ হয়ে গেলে পুজো দেবো। তাই ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলাম ভোর ভোর। টেবিলে আয় সবাই এবার।"
সুন্দর করে টেবিলে সাজানো গরম কচুরী তরকারি আর জিলিপি সাথে পায়েস। খুশি হয়ে ওঠে শুভময়," কখন করলে এসব?"
"পায়েসটাই শুধু করেছিরে,ওগুলো গরম ভাজছিলো,ভোলাকে দিয়ে আনালাম।"
স্নিগ্ধার প্লেটে ছোট্ট বাটিতে অল্প পায়েস আর একটা মিষ্টি সাথে দুটো কচুরী। পায়েসের বাটিটা তুলতেই একটা ছোট চিরকুট চোখে পড়লো। 
" বৌমা,
কত যুগ বাদে চিঠি লিখছি তাও আবার তোমাকে। আসলে ভালো কথা বলার অভ্যেস নেই তো তাই মুখে বলতে পারলামনা খুব লজ্জা লাগলো। সবসময়ই তো খারাপ কথা বলে এসেছি। শুভ জন্মদিনে আমার শুভর ঘর আলো করে থেকো। এই পায়েসটুকু তোমার জন্য কম চিনি দিয়ে ভোরবেলাতেই বানিয়েছি।
ইতি..'মা'
চিঠিটা পড়ে চোখটা জলে ভেসে গেলো স্নিগ্ধার, আজকাল অসুস্থতার পর মনটা বড় অন্যরকম হয়ে গেছে। কিন্তু মা গেলো কোথায়? সকাল থেকেই তো ভাবছিলো প্রণাম করবে।
" মা আপনি পায়েস রান্না করেছেন আমার জন্য! কিন্তু এ বাড়ির বৌ মেয়েদের যে.."
বাকিটা আর বলতে পারেনা স্নিগ্ধা, হয়ত এর উত্তর ঊষার কাছেও নেই তাই ওকে কাছে টেনে নিয়ে হাতের মুঠোয় দেন চোখে ছোট্ট চুনী বসানো ওনার জোড়া মাছ দুল আর লকেট। স্নিগ্ধার খুব পছন্দ ছিলো ডিজাইনটা। ভালোবেসে বানানো ছোট্ট একবাটি পরমান্ন হয়ত খুশির পরমায়ু আরও দ্বিগুণ করে দিলো ওদের চারজনের ছোট্ট সংসারে।
©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী: কলমে রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।
সমাপ্ত:-


উপরের ছবি - লেখিকা রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
[ লেখিকার অনুমতি নিয়ে বন্ধু পত্রিকায় প্রকাশিত হল ] 
ইতি কথা - কলমেঃ রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী ইতি কথা - কলমেঃ রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী Reviewed by Wisdom Apps on June 08, 2019 Rating: 5

আমি আর আমগাছ - প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী।

May 15, 2019

লিলুয়া স্টেশনের এক আর দু নম্বর প্লাটফর্মের শেষের দিকে, মানে বেলুড় স্টেশনের দিকে একটা বিশাল আম গাছ আছে।গাছটার গঠন ভারি সুন্দর। মোটা গুঁড়ির হাত ছয়েক ওপর থেকে ঘন ডালপালা মন্দিরের মত ওপরের দিকে উঠে গেছে। তলাটা রেল কতৃপক্ষ বেশ ভাল করে খয়েরি টাইল্‌স দিয়ে কোন এক কালে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড় বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছটার শেকড়গুলো খাবার খোঁজার তাগিদে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে আর প্রাণের বিপুল সমারোহে, আনন্দে মোটা হয়ে জায়গায় জায়গায় বাঁধানো চাতাল ফাটিয়ে দিয়েছে। এই চাতালটি আমার অফিস থেকে বাড়ি ফেরবার পথে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করবার প্রিয় জায়গা। আমার অফিস ছুটি হয় বিকেল চারটের সময়। কিন্তু আমি বেরোই পৌনে চারটে বাজলে। অফিস থেকে রিক্সায় লেবেল ক্রসিং অব্দি এসে বাকিটা হেঁটে আমার প্রিয় জায়গাটায় পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট পনেরো। ব্যাগটাকে চাতালের পরিস্কার জায়টায় রেখে জলের বোতল বের কোরে একটু জল খাই। তারপর আমগাছের তলায় চাতালটা্র ওপর গুছিয়ে বসি। ছুটির দিন আর বৃষ্টির দিন ছাড়া এটাই আমার প্রাত্যহিক রুটিন। আপ ব্যান্ডেল লোকাল আসার সময় বিকেল চারটে চব্বিশ মিনিটে। ফলে এই সময়টুকু আমি আম গাছের সান্নিধ্যে কাটাই। পরিচিত ডেলি-প্যাসেঞ্জারেরা আসেন চারটে পনেরো নাগাদ। ফলে এই ফাঁকা পনেরোটা মিনিট আমি মোবাইলে ফেস্‌বুকের আপডেট দেখে বা নেটে টাটকা খবর দেখে সময় কাটাতাম।
কিন্তু কয়েক বছর হল আমার এই নিঃসঙ্গ সময়টায় সঙ্গ দেবার একজন সঙ্গী পেয়েছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমি বসে বসে ফেসবুকে চোখ বলাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল আমার ঘাড়-মাথার ওপর দিয়ে কে একজন আমার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চমকে ঘাড় তুলে দেখি গাছটা ডাল পাতা নিয়ে ঝুঁকে যেন আমার মোবাইলটা দেখছে। ভাবলাম মজা মন্দ নয়। এই গাছটার সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান কোরলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মনে মনে গাছটাকে বললাম, “কি হে, কি দেখছ?”
হাওয়ার ফিস্‌ফিস্‌ শব্দে উত্তর এলো, “তোমার ওই যন্ত্রটায় অনেক খবর থাকে, তাই দেখি”।
 (২)
“ধ্যাৎ, তুমি তো একটা গাছ, তুমি খবর পড়বে কি কোরে? তুমি অক্ষর চেনো?”
“খবর পড়ি বলি নি তো, বলেছি খবর দেখি। তোমার ওই যন্ত্রটায় অনেক ছবি থাকে, সেগুলো দেখি আর খানিক বাদে তোমার বন্ধুরা এলে তোমরা যে বক্‌বক্‌ করো, সেগুলোকে জুড়ে নিয়ে আমি খবর পেয়ে যাই”।
“বাবা, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান গাছ হে?”
“কেন, গাছের বুঝি বুদ্ধি থাকতে নেই”।
একটু বিরক্ত হয়ে বলি, “দেখো, গাছের প্রাণ আছে, এটুকু মানতে পারি, কিন্তু, গাছের বুদ্ধি? একটু আষাঢ়ে গল্প হয়ে যাচ্ছে না?”
“বাঃ, তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে একটা গাছের সঙ্গে গল্প কোরছ, এটা যদি তোমার বন্ধুরা শোনে, তাহলে তারাও কি এটাকে আষাঢ়ে গল্প বোলবে না?”
মনে মনে একটু থমকে গেলাম। সত্যিই তো। নির্মলদা, সমাদ্দার, এরা যদি জানতে পারে যে আমি একটা গাছের সঙ্গে কথা বলি, তাহলে ওরা আমায় ব্যান্ডেল অব্দি পৌঁছতে দেবে না, তার আগে মানকুন্ডুতে নামিয়ে পাগ্‌লা-গারদে ভর্তি কোরে দেবে। একটু আমতা আমতা কোরে বলি, “হ্যাঁ--- তা বটে”।
আমগাছ উৎসাহিত হয়ে বলে, “তা হলে?”
আমি বললাম, “তা হলে একজন বুদ্ধিমান মানুষ যদি একটা বুদ্ধিমান আমগাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরতে চায়, তবে কি আমগাছ রাজি হবে?”
আমগাছ তার সব ডালপাতা দুলিয়ে বাতাসে ফিস্‌ফিসিয়ে উঠল, “রাজি----রাজি”----
এইরকম কোরে বেশ কয়েক বছর হল আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমে গাঢ় হয়েছে। আমি কোন সময় ছুটিতে যাবার আগে গাছকে জানিয়ে যাই, “কদিন থাকব না হে। ছুটিতে যাচ্ছি।
“কেন, কোথাও বেড়াতে যাবে?”
“আরে না, শালির ছেলের বিয়ে, একটু দেখাশোনা কোরতে হবে।“
“ও--- ফিরে এসে বিয়ে বাড়ির গল্প শোনাতে হবে কিন্তু”।

(৩)
আবার পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি হলে শেডের তলা থেকেই ট্রেন ধরতে হয়, তখনও কিন্তু একবার ছাতা মাথায় দিয়ে আমগাছের সঙ্গে দেখা কোরে আসি।
“বড্ড বৃষ্টি হচ্ছে হে, এখন আর তোমার তলায় বোসতে পারছি না। একটু রোদ উঠুক, তখন আসব”।
আমগাছ বিষন্নভাবে মাথা নাড়ে। এ খেলার কথা শুধু আমি আর আমগাছ জানে। সবাইকে একথা বলা যায় না। গাছের সঙ্গে কথা বোলতে হলে খুব অনুভূতিপ্রবন মন হতে হয়, সবার তা হয় না। ফলে জানাজানি হলে ঠাট্টার শিকার হতে হবে।
কদিন আগে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগটা রেখে একটু জল খেয়ে গাছতলায় গুছিয়ে বসলাম। অন্য সময় আমি এসে বসলে গাছটাই আগে কথা বলে। আজকে অন্যরকম দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হে, আজ যে বড় চুপ্‌চাপ্‌?”
“মনটা ভাল নেই।“
“কেন, কি হল আবার তোমার?”
“ওই যে সেদিন তোমরা বলছিলে না, রেলের বড়কর্তারা বিভিন্ন ষ্টেশনে শেড তৈরি করার জন্যে বড় বড় গাছের মাথার দিকটা কাটিয়ে দিচ্ছেন আর গুঁড়ি গুলোতে সুন্দর সুন্দর পশু, পাখি, মানুষের ছবি খোদাই করাচ্ছেন। তাই ভাবছিলাম আমারই বা আর কদিন, আমারও মাথাটা কেটে দিয়ে গুঁড়িতে হয়ত মুর্তি খোদাই করা হবে”।
আমি চমকে উঠলাম। তাইতো, এ কথাটা তো আমার মাথায় আসে নি। একটু সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, “আরে না না, সব গাছই কি আর কাটা হবে? তুমি তো ষ্টেশনের এক প্রান্তে রয়েছ, তোমাকে ওরা কাটবে না”।
“কিন্তু সেদিন যে তোমরাই বলছিলে এইদিকটায় একটা শেড থাকলে ভাল হয়, বর্ষার সময় খুব অসুবিধে হয় তোমাদের”!
আমার মুখে আর কথা জোগাল না। গাছটা খানিক বাদে হাওয়ায় ফিস্‌ফিস্‌ কোরে বলল, “সেদিন তুমি বন্ধুদের সঙ্গে ফেস্‌বুকে একটা ছবি দেখছিলে। সেই সিরিয়া না কোথায় যেন যুদ্ধের সময় বিষ-বাষ্পের বলি হয়েছে  কটা  বাচ্ছা

(৪)

ছেলে। ওদের ছোখগুলো আধখোলা, মুখগুলো সামান্য হাঁ হয়ে আছে। হয়ত শেষ সময়ে একবার প্রাণপণ নিশ্বাস নেবার চেষ্টা কোরেছে, বাঁচবার চেষ্টা কোরেছে। আমার মাথাটা যখন রেল বাবুরা কাটিয়ে দেবে, তখন আমার গুঁড়িতে ওই বাচ্ছাগুলোর মুখ খোদাই কোরে দিলে বেশ হয়। মরা গাছের গায়ে মরা ছেলেদের মুখ। বেশ সুন্দর হবে না? বেশ ভাল হবে না দেখতে? কি গো, তোমার ভাল লাগবে না? কথা বলছ না কেন? কথা বল। কি গো”-----



 লেখক ঃ
প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী।
কাজিডাঙ্গা, পোঃ – দেবানন্দপুর, জিলা – হুগলি,
পিন্‌ - ৭১২১২৩ ,ই-মেল – pradeepchkrbrty@yahoo.co.in





                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                              
আমি আর আমগাছ - প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী। আমি আর আমগাছ - প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী। Reviewed by Wisdom Apps on May 15, 2019 Rating: 5

বাঁশি ওয়ালা -- রাহুল মন্ডল

May 08, 2019

একদল শালিখের সঙ্গে ঝগড়া বেঁধেই গেলো বাঁশিওয়ালার । চিত্কার করে বললো , দেখছিস মন ভলো নেই ,তাও তোদের একই আব্দার গান শোনাও আর গান শোনাও ।কাল শিমুল গাছের ময়না টা বলে গেলো , তার বাড়িটা কারা যেন রাতে কেটে নিয়ে গেছে ।কত মিনতি করেছিলো সে ,শোনে নি !সারাদিন এসে সে আমার কাছে কাঁদছে ।দুই ছেলে নিয়ে কোথায় যাবে সে ??
শালিক গুলো একে অপরের দিকে তাকাল ,কিচমিচি য়ে বললো ,এই বাঁশিওয়ালা তুমি তো ভারী লোক ,সবার কষ্টে তোমার মন কাঁদে !!
বাঁশিওয়ালা বললো ,কী করবো ??মন যে মনে না !!
বাঁশিওয়ালা চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবতে লাগল ।বাঁশিওয়ালা সারাদিন লটে পুকুরের পারে বাঁশি বাজায় ,সেই বাঁশি হা করে মাছরাঙ্গা ,শালিখ,ডাহুক ,টিয়া বসে শোনে আর কত প্রসংশা করে তারা ।আর কত গল্প করে বাঁশিওয়ালার সাথে ।কাল ই তো দুটি টিয়া এসে বাঁশিওয়ালা কে বলে গেলো ,ওর দুটি মেয়ে কে শিকারী রা জোর করে ধরে নিয়ে গেলো ।শুনে সে কী ভাবলো কী জানি ,তার চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়তে লাগলো ।
রোজ শহর থেকে এ পথ দিয়ে ফেরার সময় বাঁশিওয়ালার বাঁশি শুনে লোকে রা ২পয়সার বাঁশি কিনে নিয়ে যায় ।এতে দিব্বি চলে যায় তাঁর ।
পুকুরের জলে দখিনের বাতাস খেলা করে ।গরমে ক্লান্ত কাক গুলো হা করে তাদের দুঃখের কথা বলতে চায় বাঁশি ওয়ালা কে ।কলের কাল ধোঁয়া ,ধুলো আকাশে ওড়ে ,জোর করে কেড়ে নিতে চায় আকাশের রং ॥আকাশ ডুকরে কেদে ওঠে ।আগে নবান্নের মেঠো সুরে বাতাস কত মিষ্টি গান গাইত ,বর্ষা ই গান গাইতে গাইতে চাষী রা চাষ করতে যেত ,এখন সব ইতিহাস ।সারাদিন চাষ করে ফসলের দাম পায়না তাঁরা ,ফরে রা সব লাভ নিয়ে যায় ।
বাঁশিওয়ালার সব জানা ,যা রোজগার করে তার থেকে খাবার কিনে সে খেতে বসে । কিন্ত কাক ,মইনা ,দোয়েল এসে তাঁকে কী যেন বলে ।একগাল হেসে সব খাবার তাদের দিয়ে দেয় সে ।তার বাঁশি শুনে তাঁরা তো বটেই ,পথচলতি লোকেরাও কেমন সম্মোহিত হয়ে যায় ।পাখি গুলো ,পথচলতি মানুষ গুলো তাদের কাজ কামাই করে কত গল্প করে বাঁশিওয়ালার সাথে !!মাঝে মাঝে হাটে যায় সে ।দুবেলা পুর পেট খাবার জোটে না কিন্তু খুব সুখী সে ।হাটে খাঁচায় বন্দী তিতির ,ময়না ,কাকাতুয়া ,টিয়া তাদের পুরনো বন্ধু কে পেয়ে ছাড়তেই চায়না !!কত গল্প করতে চায় । এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্য় কত কাকুতি মিনতি করে !!কিন্ত বাঁশিওয়ালা ফেকাসে ভাবে দেখে ,আর ফিরে এসে আপন মনে বাঁশিতে ফু মারে ,তারপর কী অদ্ভুত মিষ্টি সুর বেরিয়ে আসে তার বাঁশি থেকে !!
সেই কষ্ট ভরা সুরে মাঠের রাখাল , শ্মশানে মড়া খেতে যাওয়া শকুন চোখের জলে বুক ভাসায় ।কিন্তু তাতে কোন ভ্রুখেপ নেই তাঁর ,সে আপন মনে বাঁশি বজায় ।
সেদিন দুপুরে বেজায় রোদ ,চান করতে ইচেছ হল তাঁর ।গিয়ে দেখলো পুকুরের দখিন কোনে একদল গোলাপী শালুক কেঁদে বললো ,ওরা কত বিষ ফেলে জলে ,গোটা গা যেন জলে জলে ওঠে ।আমার ভাই বন্ধুরা সব জলে মরে যাচেছ গো ॥॥
বাঁশিওয়ালা চোখের জল ধরে রাখতে পারল না ।পুকুরের জলে নাচতে নাচতে ফিস ফিসিয়ে বলে গেলো ,তোর খুব কষ্ট না রে ??সে কিছু বললে না ,শুধু আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবলো ,তারপর চান করে চলে এলো ।।
এমনি করে দিন যায় ,বছর যায়...বাঁশিওয়ালার মেঠো সুর আরও পক্কতায় ভরে যায় ।এযেন এক সুরের মহা সাগর...
সেদিন সে বাঁশি শোনাচ্ছিল একদল কোকিল কে ।
ওই পথ দিয়ে রাজা যুদ্ধ জয় করে অনেক দেশ ঘুরে ফিরছিলো ।রাজার কানে গেলো ওই অপূর্ব সুন্দর মেঠো সুর ।মন্ত্রী কে ডেকে রাজা বললো , এই প্রাণ জড়ানো সুর কোথা থেকে আসছে এখুনি দেখ !!!
মন্ত্রী দুজন লোক নিয়ে ছুটল সেই সুরের পিছনে ।গিয়ে দেখে একটি এক ছাতিম তলায় অর্ধ নগ্ন বাঁশিওয়ালা আপন মনে বাঁশি তে ফু দিছেন ,আর সেখান থেকেই বেরুচ্ছে সেই হিদয় নিংরান সুর ।
সেই উসখুস রোগা পাতলা লোকটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল রাজার কাছে ।
রাজা বললো ,কে তুমি ??কী নাম তোমার ??
উত্তর এলো ,বাঁশিওয়ালা ।
কী দরুন তোমার সুর !!!আমি মুগ্ধ !!!
কত টাকা কমাও বাঁশি বেঁচে ??আমার সাথে চল আমায় গান শোনাবে ।সোনা দিয়ে মুড়ে দেবো তোমায় !! রাজা বললে ।
রাজার হুকুম ,না করে কার সাধধি....
সাদা পাথরের বিরাট রাজ প্রসাদ ।কত লোক ,কত দাস ,দাসী ।যেন এক স্বপ্নপুরি...
হুকুম হল রাজার বিশেষ লোক ,যত্নের যেন কোন খামতি না থাকে ।
দাসি তাঁকে ঘর দেখিয়ে দিল ।ঘরে সোনার আরশি ,চাদির খাট ,বাসন ,খাটে নরম গদি !!
বাঁশিওয়ালার মুখ কিন্তু ফেকাসে..
অনেক খুঁজেও রবি দাদার মুখ দেখা গেলো না ।বিকেলের মিষ্টি বাতাস আর তাঁকে আদর করে না । 
তার বন্ধু রা কী করছে তাঁর জন্য় মন কেঁদে ওঠে ।মাঝে মধ্যে একদল গোলা পায়রা গল্প করে যায় ওতে মন ভরে কিন্তু বুক ভরে না ।
তাঁর চার পাঁচটি ঘর পেরিয়ে রাজার বসার ঘর ,সেখানেই সোনার খাঁচায় বন্দী ময়নাপুরের কাকাতুয়া ।দমবন্ধ জীবনে একটাই বন্ধু বাঁশিওয়ালার ।কত গল্প বলে কাকাতুয়া টা !!
তাদের গ্রামের সেই নদীর গল্প ,যেখানে একদল রাজহাঁস সারাদিন জলকেলি করতো ।দামোদর গোপালের সেই পুরনো মন্দিরের গল্প ।যেখানে বটগাছের উপর কত পাখি গান গাইত ।বাবা ,মা ,ভাই ,বোনেদের সাথে বর্ষার বৃষ্টিতে সবুজ ফাঁকা মাঠে কত খেলা করেছে ,কত গড়াগড়ি খেয়েছে সে !!
গল্প করতে করতে কাকাতুয়া টা তার ফাঁদে পড়ার কথা মনে পড়লেই মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠে সে ।
বাঁশিওয়ালা প্রতিদিন রাজাকে বাঁশি শোনায় ।কিন্তু আগের মত আর সুর আসেনা তাঁর ।কত চেষ্টা করে !!কিন্তু সুর কোথায় আসে ??
রাজা ভাবে হইতো কোন কষ্ট হচেছ ।এই নিয়ে মন্ত্রী কে বকা ঝকা করে ।পর পর দুই বছর রাজ্যে খরা ,ফসল  হয় নি ,রাজার মন খারাপ ,ডাক পড়ল বাঁশিওয়ালার ।
এসে বাঁশি তে ফু দিল সে !!!
কিন্তু সুর কই ???
অনেক চেষ্টাতেও সুর বেরুলো না তাঁর !!
কাঁদতে কাঁদতে রাজার পা জড়িয়ে ধরল সে !!
বলল মহারাজ আর পারছি না । 
সব বুঝতে পারল রাজা ,
মন্ত্রী কে বলল ,এক হাজার সোনার টাকা দিয়ে একে মুক্তি দাও!!
বাঁশি ওয়ালা রাজার পা ধরে বলল ,কী হবে মোহরে!!
রাজা বলল ,কী চাও ???
সে আকুল হয়ে বললো ,ময়নাপূরের কাকাতুয়া টা আমায় দেন মহারাজ ।আর আইন করে গাছ কাটা বন্ধ করুন ।দেখবেন খরা আর হবে না ।
পরের দিন খুব সকলে রাজ প্রসাদ থেকে বেরুলো বাঁশিওয়ালা ,হাতে ময়নাপুরের কা কাতুয়া টা !!!
আকাশের দিকে তাকিয়ে বাঁশিওয়ালা বললো , আহ কী আনন্দ.....



লেখক --

রাহুল মন্ডল

চাঁদনী পাড়া ,সিউরি ,বীরভূম
পশ্চিম বঙ্গ
বাঁশি ওয়ালা -- রাহুল মন্ডল বাঁশি ওয়ালা -- রাহুল মন্ডল Reviewed by Wisdom Apps on May 08, 2019 Rating: 5

রমেনের রাগ , লেখকঃ প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী

April 04, 2019
     
 জ্ঞান হওয়া অব্দি রমেন মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে বাবা মায়ের ওপর। কেন রাগবে না? আজকাল বাবা মায়েরা কতো ভেবে ভেবে, কতো খুঁজে পেতে ছেলে-মেয়ের নাম রাখেন। যেমন “তালদ্ধজ”, “ইরম্মদ”, ইত্যাদি ইত্যাদি। নাম শুনে লোকে চমকে তাকাবে। কত পারসোনালিটি বেড়ে যায় নামের গুনে। আর ওর নাম, রমে—ন। একটা অত্যন্ত সাধারন, মিন্‌ মিনে নাম। তার ওপোর সেই নামটাকেও ছোট কোরে ডাক-নাম রেখেছেন “রমা”। ছোটবেলায় স্কুল ছুটির পর মা নিতে আসতেন। গেটের বাইরে বাচ্ছাদের নিতে আসা অভিভাবকদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাঁক দিতেন, “রমা, এইদিকে আমি, চলে আয়”। ব্যস্‌, সহপাঠীদের কানে এই নাম যেতেই রমেন একটা মজার খোরাক হয়ে গেল। স্কুলে গেলেই, “এই রমা, ফ্রক পরিস নি কেন” বা “রমা, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাস” জাতিয় কতগুলি সম্ভাষণ ওর দিকে উড়ে আসত। প্রথম দিকে এই নিয়ে মারপিটও হয়েছে, কিন্তু পরে রমেন ব্যপারটাকে মানিয়ে নিয়েছিল। ওর নাম নিয়ে মজা করবার লোক অনেক, কজনার সঙ্গে লড়বে? এই নামের জন্যেই ও ছোট বয়স থেকেই একটা হীনমন্যতার শীকার হয়ে গিয়েছিল। ওর ধারনা হয়ে গিয়েছিল এই নাম নিয়ে জীবনে খুব বেশি কিছু করা যায় না।
       সহপাঠীদের মধ্যে অভিজিৎ, সিদ্ধার্থ, ফার্স্ট-সেকেন্ড হোত। রমেন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা কোরেও ওদের মত অত নম্বর পেত না। তার জন্য ও দায়ী করত নিজের নামকে। রমেন যার নাম তার বুদ্ধি-সুদ্ধি কখনোই খোলতাই হতে পারে না।  
      


(২)

       টেনে-টুনে সেকেন্ড ডিভিসনে বারো ক্লাস পাশ কোরে কমার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন কোরতে পাতি একটা কলেজে ভর্তি হল রমেন। সিদ্ধার্থ জে ই তে দুর্দান্ত রেজাল্ট কোরে আই আই টি কানপুরে ভর্তি হল। অভিজিৎ মেডিকেল ক্লিয়ার কোরে ডাক্তারি পড়তে গেল। আর রমেনের ভাগ্যে পাশকোর্সে কমার্স। সব ওই নামের জন্যে। জন্মানোর সাথে সাথে রমেন নাম রেখে বাবা-মা ওর ভাগ্য শীল কোরে দিয়েছেন।  
       রমেনকে দেখতে বেশ ভালই, কিন্তু কো-এড কলেজে সহ-পাঠীনিদের ও সযত্নে এড়িয়ে চলত। ওর কলেজের বন্ধুরা যখন এক-একটি টেম্পোরারি প্রেমিকা যোগাড় কোরে নিয়েছে, তখন রমেন সেই একা। মেয়েরা কি নামে ডাকবে ওকে, “এই রমেন” বা “রমেন-দা”। ইস্‌, কি বিশ্রী। এবং এই স্বভাবের জন্যেই মেয়ে-মহলে ওর “লাজুক ছেলে” বোলে নাম রটে গিয়েছিল। ওর অভিজ্ঞ বন্ধুরা বোলত, “ওরে, মেয়েরা ছেলেদের মধ্যে ম্যাচো ভাব দেখতে চায়। তোর ওইরকম ম্যাদা মারা ভাব দেখলে ওরা তোর ধারে-কাছে ঘেঁসবে না”। কোনও জবাব দিত না রমেন। কিন্তু মনে মনে বলত, “যার নাম রমেন, ডাক-নাম রমা, সেতো ম্যাদা-মারা হবেই। গোড়ায় গলদ হোয়ে গেছে”।
                   বি কম পাশ কোরেই চাক্‌রির খোঁজে হন্যে হয়ে লেগে পড়ে রমেন। কারণ রমেনের নিজের সম্বন্ধে কোন ভুল ধারনা ছিল না। পাশ কোর্স বি কম পাশ ছেলের উচ্চশীক্ষার পথ এমনিতেই বন্ধ। তার ওপর উচ্চশীক্ষা আজকের দিনে ব্যয় সাপেক্ষ।  বাবা  বছর  খানেক  হল পোস্ট

(৩)

অফিসের চাকরি থেকে রিটায়ার কোরেছেন। হাজার দশেক টাকা পেনশন পান। রিটায়ারমেন্টের সময় থোক টাকা যা পেয়েছেন তার খানিকটা পৈতৃক বাড়িটা সারাতে লেগেছে। আর বাকিটা এম আই এস করা আছে। বাবার পেনশনের টাকায় তিনজনের আজকালকার বাজারে খাওয়া পরা চলাই রীতিমত কষ্টকর। তবু ভাগ্য ভাল যে রমেনের দাদুর আমলের তৈরি বাড়িটা আছে। রমেনদের বাড়িটা উল্টডাঙ্গার একটা গলির মধ্যে। একতলা বাড়ি। ভালই হয়েছে, রাস্তার ওপর বাড়ি হলে প্রোমোটারদের অত্যাচারে তিষ্ঠনো যেত না।   
       তাই বাস্তববাদী রমেন চাকরির চেষ্টা আরম্ভ করে এবং ওর কলেজের বন্ধুর কাকার সুপারিশে সল্টলেকের একটা কন্সট্রাকসন কোম্পানির অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরি পায়। বি কম পড়বার ফাঁকে যুব কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কিছুদিন তালিমও নিয়েছে। ফলে মাসিক সাত হাজার টাকা মাইনেতে রফা হয়। রমেনের পক্ষে যথেষ্ট। ওর বন্ধু সৌমেনের কাছে ও কৃতজ্ঞ। ওই ওর কাকার কাছে তদ্‌বির কোরে রমেনের চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছে। ওর কাকা কোম্পানির চিফ্‌ অ্যাকাউন্টেন্টের বন্ধু। নইলে রমেনের মত একটা অনভিজ্ঞ সদ্য গ্রাজুয়েটকে কে চাকরি দেয়!  
                   সেই চাকরিতেই আজ বছর পাঁচেক হল টিকে আছে রমেন। ভদ্র, ন্ম্র ব্যবহারের জন্যেই হোক বা রমেনের কাজ-কর্মে মনোযোগের জন্যেই হোক, চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট সাহেব ওকে খুব পছন্দ করেন। ওনারই সুপারিশে এই পাঁচ বছরে রমেনের মাইনে দশ হাজারে এসে ঠেকেছে। সকাল দশটা থেকে অফিস। সাড়ে নটার মধ্যে বাস ধরে উল্টোডাঙ্গা থেকে করুনাময়ীর মোড়ে চলে আসে। ওখান থেকে রমেনের অফিস  পায়ে  হেঁটে


(৪)
মিনিট পনেরো। অটো পাওয়া যায়। কিন্তু রমেন পায়ে হেঁটেই যায়। যতটা পয়সা বাঁচানো যায়। অফিস যাবার পথে বাঁদিকে পড়ে মধুদার হোটেল। হোটেল মানে বিরাট কিছু না। রাস্তার ধারে একটা বড় ঘরকে পারটিশন দিয়ে খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘর আর ক্যাশ কাউন্টার। সকালে চা, টোস্ট, ঘুগনি আর ডিম ভাজা। দুপুরে ভাত, ডাল, মাছের তরকারি। শুক্কুরবার মাংস হয়। বিকেলে চা, টোস্ট, আলুর-দম। রাত্তিরে রুটি, সবজি, আন্ডা-কারি। আশেপাশের অফিসগুলোর দৌলতে মধুদার রোজগার ভালই হয়। বিশেষত কল-সেন্টারের ছেলেগুলোর ঠেক হচ্ছে মধুদার হোটেল। রমেন বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। মা সকালবেলা বানিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে দেন। রমেন সকাল বা বিকেলের দিকে মধুদার দোকানে যায় চা-বিস্কুট বা কখনো-সখনো ডিম ভাজা খেতে। এই পাঁচ বছরে মধুদার সঙ্গে বেশ ভালই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।  
                   এই রকম গতানুগতিক ভাবেই চলছিল রমেনের জীবন। এর থেকে অন্যরকম কিছু হবে তা রমেন স্বপ্নেও ভাবেনি। যার নাম রমেন তার জীবনে নাটকীয় কিছু হতে পারে কখনও? কিন্তু জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা আগে থেকে ভাবা যায় না। রমেনের জীবনেও তাই ঘটল। ঘটনাটা একটু খুলেই বলা যাক।
       সময়টা তখন শীতকাল। অন্যান্য দিনের মতোই সন্ধ্যে ছটার সময় দিনের কাজ সেরে, চীফ অ্যাকাউন্টেন্ট পালিত সাহেবের অনুমতি নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরবে বলে বেরোল রমেন। বাইরে তখন বেশ ঘোর ঘোর হয়ে এসেছে।ওর অফিস থেকে একটু দুরেই একটা মস্ত মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং আছে। ওখানে অনেকগুলো কোম্পানির অফিস। ওই  অফিস  আর


(৫)

মধুদার দোকানের মধ্যিখানে ফুটপাথ ঘেঁসে একটা বাইক দাঁড় করানো ছিল। রমেন দেখলো বাইকের কাছে ফুটপাথের ওপর একটা ছেলে, একটা মেয়ের গলার কাছে ছুরি ধরে আছে আর অন্য আরেকটা ছেলে মেয়েটার গাল টিপে ধরে অসভ্যতা করবার চেষ্টা কোরছে। ভয়ে মেয়েটা কোন আওয়াজ কোরতে পারছে না। দেখার সাথে সাথেই রমেন চিৎকার কোরে উঠল, “এই, কি হচ্ছে!”
       ছুরি হাতে ছেলেটা চট্‌ কোরে রমেনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। “মাক্‌ড়া, চুপ্‌-চাপ্‌ কেটে পড়, নইলে চার ফালা কোরে দেব”। তার সাথে আরো কতকগুলো অশ্রাব্য খিস্তি কোরল ছেলেটা।
       এতদিনের মধ্যবিত্ত জীবনের পুঞ্জিভূত সমস্ত অপমান, অবদমন, ওই ছেলেটার গালগাল শুনে যেন ক্রোধের রূপ নিয়ে ফেটে পড়ল রমেনের শরীরে। ভাল কোরে কিছু ভাবার আগেই, “তবে রে শালা!” বোলে রমেন দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল ছুরি হাতে ছেলেটার ওপোর। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব কোরল নিজের বাঁ হাতের ওপর-বাহুর কাছে। ছেলেটা আচমকা রমেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর। পড়ার ধাক্কায় ততক্ষনে ওর ছুরিটা হস্তচ্যুত হয়েছে। ছুরি খাওয়া হাতের যন্ত্রনা ভুলে রমেন বুকের ওপোর বসে এলোপাতাড়ি ঘুঁসি মারছিল ছেলেটার মুখে। অন্য ছেলেটা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বন্ধুকে সাহায্য কোরতে আসছিল। মেয়েটা ছাড়া পেয়ে “বাঁচাও, বাঁচাও” বোলে চিৎকার কোরতে আরম্ভ কোরল। ইতিমধ্যে মধুদা দোকানের মধ্যে থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ আর মেয়েটার চিৎকার শুনে বাইরে উঁকি মেরেই ব্যাপার বুঝে নিয়েছিল।  ফলে


(৬)

যে পেল্লায় খুন্তিটা দিয়ে আলুর-দম নাড়ছিল, সেটাকেই মাথার ওপোর তুলে মার-মার কোরে তেড়ে এলো। তার পিছনে কয়লা ভাঁঙা হাতুড়িটা নিয়ে রে-রে কোরে ছুটে এল মধুদার অ্যাসিস্টান্ট পাঁচু। আর তার সাথে সাথে আই-টি সেক্টারের যে ছেলেগুলো মধুদার দোকানে খেতে এসেছিল, তারা “ডাকাত-ডাকাত” কোরে দৌড়ে এল। পরিস্থিতি ঘোরালো দেখে দ্বিতীয় ছেলেটা চট্‌ কোরে বাইকে উঠে মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটাকে চেঁচিয়ে বল্‌ল, “ভাগ ইয়ার, পাকড়ে যায়েঙ্গে”। মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটা সজোরে ঘুঁসি মারল রমেনের বুকে। রমেন ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর। সাথে সাথেই মাটি থেকে উঠে পড়ে ছেলেটা বাইকের পিলিয়নে উঠে পড়ল এক লাফে। নক্ষত্র বেগে বাইকটা শীতের সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মহিষবাথানের দিকে। সমস্ত ঘটনাটা মিনিট দুই তিনের মধ্যে ঘটে গেল।
                   ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের ক্ষতটা চেপে ধরে আস্তে আস্তে উঠে বসল রমেন। মেয়েটা দৌড়ে এসে পাশে বসে ওর হাতে হাত রাখল। “একি, আপনার তো চোট লেগেছে, রক্ত পড়ছে!” এই প্রথম স্বেচ্ছায় কোন মেয়ে ওর হাতে হাত রাখল। যন্ত্রনার মধ্যেও একটু সুখের শিহরন খেলে গেল রমেনের শরীরে। ততক্ষনে মধুদা দল-বল নিয়ে এসে পড়েছে। ক্ষতটা জামার ওপর দিয়েই এক পলক দেখে মধুদা বল্‌ল, “এতো ছুরি খেয়েছে! পাঁচু, একটা অটো থামা”। নির্দেশ পেয়েই পাঁচু দৌড়ে গেল রাস্তায়। গোপাল অটো নিয়ে আসছিল। পাঁচুর কাছে ব্যাপার শুনে প্যাসেঞ্জারদের নেবে যেতে বলল। এই অঞ্চলে মধুদাকে সবাই চেনে এবং মানে। মধুদা রমেনকে ধরে ধরে অটোয় তুল্‌ল। মেয়েটাও পাশে এসে বসল।
      

(৭)

       “হোটেলটা সামলা পাঁচু, আমি শ্যামল ডাক্তারের চেম্বারে যাচ্ছি”।  
       “ঠিক আছে মধুদা, আমি সামলে নেব”।
       গোপাল অটো স্টার্ট দিল। শ্যামল ডাক্তারের চেম্বার করুনাময়ীর কাছেই। পথে যেতে যেতে মেয়েটার কাছে সংক্ষেপে ঘটনাটা জেনে নিল মধুদা। মেয়েটার নাম শ্রাবনী। বাড়ি শিলিগুড়ি। বাবা, মা আর ছোট একটা ভাইকে নিয়ে সংসার। বাবা রিটায়ার্ড। পেনশন পান। মা স্কুলের শিক্ষিকা। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। গ্রাজুয়েশনের পরে আজকালকার মেয়েদের মতই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে শ্রাবনী। মধুদার হোটেলের আগেই যে অফিস বিল্ডিঙ্গটা রয়েছে, ওখানেই একটা অফিসে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। থাকে করুনাময়ীর মোড়ের ট্যাঙ্কটার কাছেই একটা মেয়েদের পিজিতে। বাবা প্রথমে এত দূরে মেয়েকে চাকরি কোরতে দিতে চান্‌নি। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে শেষ অব্দি হার মানতে হয়েছে।   
       গত কয়েকদিন ধরেই ওই ছেলেদুটো বিরক্ত কোরছে। একটা বাঙালি আর অন্যটা অবাঙালি। শ্রাবনী সন্ধ্যে বেলায় অফিস থেকে বেরোলেই বাইকে কোরে পাশে পাশে যেতে যেতে আপত্তিকর মন্তব্য করে। প্রথমে ও অতটা পাত্তা দেয় নি। কিন্তু আজ অবস্থাটা চরমে গিয়েছিল। রাস্তাটা নির্জন দেখে বাইক থেকে নেমে ওর পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। অবাঙালি ছেলেটা ওর হাত চেপে ধরেছিল। রেগে গিয়ে শ্রাবনী ওর গালে একটা চড় মারে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি ছেলেটা ওর পকেট থেকে ছুরি বার কোরে শ্রাবনীর গলার কাছে ধরে। তার পরের ঘটনা তো জানাই আছে।


()

       ডাক্তারবাবু চেম্বারেই ছিলেন। মধুর মুখে সব শুনে আর রমেনের জামাটা খুলে ক্ষতস্থান পরীক্ষা কোরে ডাক্তারবাবু বললেন, “জোর বেঁচে গেছে। আচমকা লাফিয়ে পড়ায় ঠিক মতো ছুরি চালাতে পারে নি। মাস্‌লের কাছে একটু কেটে গেছে। সুপারফিসিয়াল ইঞ্জুরি। আমি প্রেশার ব্যান্ডেজ কোরে দিচ্ছি। তার সঙ্গে ইঞ্জেকশান দিয়ে দিচ্ছি। কতকগুলো ওষুধ লিখে দিচ্ছি। চারদিন খেতে হবে। ভয়ের কিছু নেই। কালকে এসে একবার দেখিয়ে যাবে। তবে মধু, একবার পুলিশকে জানান দরকার ছিল না?”
       “ছাড়ুন তো পুলিশ”। খেঁকিয়ে উঠল মধু। “ওদের আমার জানা আছে। থানার বড়বাবু থেকে আরম্ভ কোরে সবকটাকে আমি চিনি। কিচ্ছু কোরবে না। শুধু শুধু এই ছেলেটা আর মেয়েটাকে হয়রানি করাবে। যা করবার তা আমিই কোরব। আমার এরিয়াতে এসে এত বড় বাঁদরামি?”
       এখানে মধুর একটু পূর্ব পরিচয় দিয়ে রাখা ভাল। এক কালে মধু এই অঞ্চলের নামজাদা মস্তান ছিল। থানা, পুলিশ, শ্রীঘর, সবই ওর ভাল রকম জানা আছে। মধু, ওর মধ্যযৌবনে, ওরই এক প্রতিদ্বন্দ্বী মস্তান খুন হোয়ে যাবার পর, তার প্রেমিকাকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। তারপর তাকে বিয়ে করে। সেই মেয়ের প্রভাবই মধুর আজ এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ধীরে ধীরে মধু অসামাজিক কাজ থেকে সরে আসতে আরম্ভ করে। তারপর এই হোটেল খুলে বসে। কিন্তু বাঘ কখনও নিরামিষাশী হতে পারে না। তাই আজও পাড়ার ক্লাবে, থানায়, আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মধুর বেশ দহরম মহরম আছে। ওকে এই অঞ্চলের লোক রীতিমতো সমীহ কোরে চলে। পরোপকারী বলেও ওর বেশ নাম আছে।


(৯)

       চেম্বার থেকে বেরিয়ে মধু গোপালকে বলল, “গোপাল, তুই আমাকে করুনাময়ীর মোড়ে নামিয়ে দিয়ে শ্রাবনিকে ওর পিজির কাছে ছেড়ে দে। তারপর তুই রমেনভাইকে উল্টোডাঙ্গায় ওর বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আয়”।
       “আরে না, না। আমি বাসে কোরে চলে যেতে পারব”। প্রতিবাদ কোরে উঠল রমেন।
       “যা, বলছি তাই কর, পাকামি কোরো না”।
       মধুদার ধমক খেয়ে আর কিছু বলতে সাহস করল না রমেন। মোড়ের মাথায় নামল মধুদা।
       “যেমন তোমরা অফিস যাচ্ছ, তেমনি যাবে, বুজেছ। বোনটি, কোনো ভয় নেই। আর রমেনভাই, একদম চিন্তা কোরো না। আমি যখন এই ব্যাপারে মাথা গলিয়েছি, তখন তোমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার হিম্মত কোনো মাইকা লালের হবে না”। তারপর রমেনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “সাবাস রে ভাই, মরদ কা বাচ্চার মতো কাজ করেছিস”।
       লজ্জা পেয়ে গেল রমেন। একবার আড়চোখে পাশে বসা শ্রাবনীর দিকে তাকাল। শ্রাবনীও তাকিয়েছিল ওর দিকে। রমেন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিল মধুদা। একটু এগিয়েই শ্রাবনীর পিজির সামনে অটো দাঁড়াল।
       “আসি গোপালদা। রমেনদা, আমার জন্যে আপনি যা কোরলেন। আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেবেন?”
      


(১০)

       চমকে শ্রাবনীর দিকে তাকাল রমেন। হ্যাঁ, ওকেই বোলছে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোনো মেয়ে যে ওর ফোন নাম্বার চাইতে পারে, এটা ও স্বপ্নেও ভাবে নি। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে নিজের মোবাইল নম্বরটা বলল। নম্বরটা মোবাইলে শেভ কোরে রমেনের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত কোরল শ্রাবনী। রমেনের দিকে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ফিক্‌ কোরে হেসে ফেলল। তারপর, “চলি রমেনদা” বোলে পিজির দিকে চলে গেল। ওর এই শেষের ভঙ্গীটার কোন মানেই খুঁজে পেল না রমেন। গোপাল অটো ছেড়ে দিল।
                   সারাটা রাস্তা মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল রমেনের। বেশ দেখতে মেয়েটাকে। মাজা মাজা রঙ আর চোখে মুখে একটা চটক আছে। পুরুষের চোখ আর মন, দুইই টানে। একটা হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছিল। বেশ মানিয়েছিল। আর ভীষন স্মার্ট মেয়েটা। আজ যা কান্ড ঘটেছিল, তারপর যে কোনো বঙ্গ ললনা কেঁদে কেটে মুর্চ্ছা যেতেন। কিন্তু প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে উঠে মেয়েটা বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল। মধুদা, গোপালদার সঙ্গে তো বটেই, ওর সঙ্গেও সাবলিল ভঙ্গীতে কথা বলছিল। রমেনই বরঙ সহজ হতে পারে নি। ওর ব্যবহারেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল।
       বাড়ির গলির মুখে নেমে গোপালদাকে ভাড়া দিতে গেল রমেন। গোপালদা কিছুতেই নিল না। বলল, “তুমি আমাদের পাড়ার ইজ্জত বাঁচিয়েছ ভাই। তোমার কাছ থেকে আজ ভাড়া নিতে পারব না”।
      


(১১)

       বাড়ি ফিরে এক কাঁড়ি মিথ্যে কথা বলতে হল রমেনকে। ওর ধূলোমাখা, ব্যান্ডেজ করা চেহারা দেখে বাবা, মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। রমেন বলল রাস্তায় অটোর ধাক্কা খেয়ে ভাঙা কাঁচের ওপর পড়ে গিয়েই এই বিপত্তি। ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। আসল ঘটনা বাবা মা জানলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র আরম্ভ হয়ে যেত। রমেন কেন দুঃসাহস দেখাতে গেছে সেই কৈফিয়ৎ দিতে দিতে পাগল হয়ে যেত। জামা কাপড় ছেড়ে, মুখ হাত ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে, মায়ের দেওয়া এক বাটি চিঁড়েভাজা আর চা খেয়ে রমেন মোবাইলটা নিয়ে চাদর গায়ে জড়িয়ে একতলার ছাদে উঠল। এটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। দিনের শেষে অফিস থেকে ফিরে খানিক্ষন ছাদে এসে বসা। আরাম কোরে নিজের পছন্দের জায়গাটায় বসল রমেন। এখান থেকে গলির মোড়ের লোকজন, যানবাহন চলাচলের খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। মাথা থেকে চাদরটা মুড়ি দিয়ে নিল রমেন। বেশ হীম পড়ছে। আজ ওর মনটা ভীষন খুশি। এতদিনে একটা কাজের মত কাজ কোরতে পেরেছে। যদিও ও নিজেই এখনো বুঝতে পারছে না, কি কোরে ওই ছুরি হাতে ছেলেটার ওপর সাহস কোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শ্রাবনীর হাতের স্পর্শটা এখনও যেন অনুভব কোরতে পারছে নিজের হাতের ওপর। আর ওর মুখে ওই রমেনদা ডাকটা? ওই ডাকের পর থেকেই নিজের নামটাকে আর বিচ্ছিরি মনে হচ্ছে না।আজ নিজেকে বেশ হিরো বলে মনে হচ্ছে। শুধু একটাই কাঁটা মনের মধ্যে খচ্‌খচ্‌ কোরছে। বিদায়ের আগে ওর দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ওরকম ফিক কোরে হাসল কেন শ্রাবনী? চিন্তা কোরতে কোরতে অন্যমনস্ক ভাবে নিজের মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে  ছিল
   

(১২)

রমেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মাথায় এল। ইস্‌, ছি, ছি, ছি। এটা ও কি কোরে ফেলেছে? কথাটা কেন তখনই মাথায় আসে নি? মেয়ে হয়ে শ্রাবনী যেচে ওর ফোন নাম্বারটা চাইল, আর ও কিনা ফোন নাম্বারটা দিয়ে চুপ্‌চাপ্‌ বসে রইল? ভদ্রতার খাতিরেও ওর উচিৎ ছিল শ্রাবনীর ফোন নাম্বারটা চাওয়া। এর পরেও ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাসবে না মেয়েটা? কি ভাবল ওকে, প্রথম শ্রেনীর ক্যাবলাকান্ত? যতটা হিরো হয়েছিল শ্রাবনীর চোখে ততটাই জিরো হয়ে গেল। হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল খামচে ধরল রমেন। নিজের নামের ওপর রাগটা আবার দ্বিগুন হয়ে ফিরে এল। আর কি ওর সঙ্গে দেখা কোরবে শ্রাবনী? কেন কোরবে? ওর মত একটা আনস্মার্ট ছেলের সঙ্গে শ্রাবনীর মত স্মার্ট মেয়েরা সম্পর্ক রাখে না।
       মোবাইলটা হঠাৎ সরব হয়ে উঠল রমেনের হাতে। অপরিচিত নম্বর। হয় মোবাইল কোম্পানি, নয় অন্য কোন কোম্পানির অ্যাড্‌। অনিচ্ছা সত্বেও ফোন ধরে বিরক্ত গলায় বলল, “হ্যালো”।
       ওপাশ থেকে মিস্টি মেয়েলি গলায় আওয়াজ এলো, “হ্যালো রমেনদা, আমি শ্রাবনী। কেমন আছেন?”
       চমকে গিয়ে হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।
       “হ্যালো শ্রাবনী, আমি ভাল আছি”।
       “হাতের ব্যাথা কি বেড়েছে?”
       “আরে না না। ডাক্তারবাবুর ওষুধ খেয়ে বেশ ভালই আছি। চিন্তার কিচ্ছু নেই”।
       “যাক্‌, নিশ্চিন্ত হলাম। কি কোরছিলেন?”
       “এইইই, ছাতে বসে আছি”।

(১৩)

       “ছাতে, এই ঠান্ডার রাতে? অসুখে পড়বেন তো?”
       “না না, কিছু হবে না। অনেক দিনের অভ্যেস”।
       “হোক অভ্যেস, আজ আপনার শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। আর ঠান্ডা খেতে হবে না, ঘরে শুয়ে রেস্ট করুন, বুঝলেন?”
       এই তো কঘন্টার আলাপ। এর মধ্যেই মেয়েটা কিরকম শাসন কোরছে। রমেনের বড় ভাল লাগছে ওর গলায় ওই হুকুমের সুরটা শুনতে। নিজেকে প্রস্তুত কোরে নিল রমেন। কথাটা বলতেই হবে।
       “ঠিক আছে, ঘরে যাচ্ছি রেস্ট কোরতে, কিন্তু তার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি জবাব দেবেন?”
       “কি কথা?”, বিস্ময়ের সুর ভেসে এল ওপ্রান্ত থেকে”।
       “আপনি আমাকে খুব অসভ্য মনে কোরেছেন, না? আপনি আমার ফোন নম্বর নিলেন, অথচ আমি একবারও আপনার নম্বরটা চাইলাম না। খুব বাজে ব্যবহার কোরেছি আপনার সঙ্গে। সেই জন্যেই আপনি যাবার আগে আমার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে হেসে চলে গেলেন, না? কিন্তু, বিশ্বাস করুন”---
       “এই যে মশাই,” কথার মধ্যিখানেই ওকে বাধা দিল শ্রাবনী। “আপনারা, পুরুষরা মেয়েদের মনের সব কথা জানেন, এই রকম অহঙ্কার রাখেন কেন বলুন তো? কতটুকু জানেন আমরা কি পছন্দ করি বা না করি? শুধু নিজেদের মনগড়া আইডিয়া নিয়ে বসে থাকেন। শুনুন, আমরা যেমন যে ছেলে একটা অপরিচিত মেয়ের  সম্মান  বাঁচাতে  ছুরির  মুখে


(১৪)

ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাকে পছন্দ করি, তেমনিই পছন্দ করি সেই ছেলেকে যে মেয়েদের সাহায্য করার বিনিময়ে কোন অ্যাড্‌ভান্টেজ নিতে চায় না। আপনি সভ্য, ভদ্র, নম্র ছেলে আর মেয়েদের সামনে একটু লাজুক। ওটা আমরা বুঝি। অন্য কারো কথা জানিনা, আমি অন্তত সেটাই পছন্দ কোরি। ওপোর-চালাক ছেলেদের আমি একদম দেখতে পারিনা। আপনার মত লাজুক ছেলে আজকাল তো আর বিশেষ দেখা যায় না। তাই আপনার লাজুক ভাব দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম। সেইজন্যে আপনি ব্যথা পেয়েছেন, রাগ কোরেছেন আমার ওপর? প্লিজ রাগ কোরবেন না, আমি ক্ষমা চাইছি”।
       “আরে ছি ছি, কি বোলছেন? আমি একদম রাগ করি নি”। উৎকন্ঠিত গলায় উত্তর দেয় রমেন।
       “ঠিক তো, রাগ করেন নি তো? বেশ, তাহলে লক্ষী ছেলের মত এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর হ্যাঁ, কাল সাড়ে-নটার সময় করুনাময়ীর মোড়ে আসছেন তো? একসঙ্গে দুজনে অফিস যাব”।
       “আপনি আমার সঙ্গে যাবেন?”
       “হ্যাঁ, আজকের ঘটনার পরে আমার খুব ভয় ধরে গ্যাছে। ভেবেছি, যখন দুজনেরই অফিস একই সময়ে তখন যাওয়া আসাটা একসঙ্গেই করব। আপনার আপত্তি নেই তো?”
       “আপত্তি? কি বোলছেন? আমি একদম রাজি”।
       ওপার থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে এল। “বেশ, তাহলে ওই কথাই রইল। শুভরাত্রি রমেনদা। আর হ্যাঁ, এবার আমার ফোন নম্বরটা সেভ কোরতে ভুলবেন না যেন। তাহলে কিন্তু আমি খুব রাগ কোরব”। আবার একঝলক হাসি ভেসে এল। ফোনটা ডিস্কানেক্ট হল।

(১৫)

       রমেন খানিকক্ষন ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে তাকাল শীতের ঝকঝকে তারাভরা আকাশটার দিকে। আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে। এতদিনের অপমান, অবদমন, যেটা চাপা রাগ হয়ে আগুনের মত ওর ভেতরে জ্বলতো, তার ওপর শ্রাবন ধারার শীতলতা নিয়ে ঝরে পড়ছে শ্রাবনী। 

প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী।
কাজিডাঙ্গা, পোঃ – দেবানন্দপুর, জিলা – হুগলি, পিন্‌ - ৭১২১২৩
ই-মেল – pradeepchkrbrty@yahoo.co.in
রমেনের রাগ , লেখকঃ প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী রমেনের রাগ , লেখকঃ প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী Reviewed by Wisdom Apps on April 04, 2019 Rating: 5
Powered by Blogger.