ছোটবেলায় বিজ্ঞানে কোন আগ্রহ ছিল না পরমানু বিজ্ঞানীর - হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জীবনী

হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা (জন্ম : ১৯০৯ খ্রি.,মৃত্যু : ১৯৬৬ খ্রি.)


তাঁকে বলা হয় ভারতের পরমাণু শক্তি গবেষণার পথিকৃৎ। বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।


অথচ ছোটবেলার দিনগুলিতে কখনোই তিনি বিজ্ঞানকে ভালোবাসেননি। ভালোবেসেছিলেন সাহিত্য। লুকিয়ে লুকিয়ে সুন্দর কবিতা লিখতেন। সেই কবিতার মধ্যে ছন্দের বাহার থাকত। থাকত অলঙ্কারের বহিঃপ্রকাশ। শব্দচয়নে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন সেদিনের কিশোর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। চারপাশের পৃথীবিতে যেসব ঘটনা ঘটছে, তাকে কেন্দ্র করেই কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন তিনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন সূর্যাস্তের দিকে। এক লহমাতে পৃথিবীর বুকে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। আলোর উৎসার এবার বন্ধ হল। পৃথিবীতে নেমে আসছে রাত্রির অন্ধকার। প্রাকৃতিক এইসব ঘটনা সেদিনের কিশোর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। যা দেখতেন চোখের সামনে, তাই লিখে রাখতেন খাতার পাতায়। এইভাবেই ষোলো বছর বয়সে অনেকগুলি ভালো কবিতার জনক হয়েছিলেন তিনি।


কবিতার সঙ্গে সঙ্গে ছিল ছবি আঁকার ঝোঁক। রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতেন বসতেন। স্কুলের পাঠ্যক্রম মোটেই ভালো লাগত না তাঁর। তবুও কৃতিত্বের সঙ্গেই পড়াশোনা শেষ করেছিলেন।


কবিতা জাহাঙ্গীরের অসম্ভব আগ্রহ ছিল। আর ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীতে ভালোবাসা। গাইতে পারতেন খুব ভালো। রোজ সকালে ভৈরবীতে গলা সাধতেন। প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যেত। তাঁরা তন্ময় হয়ে যেতেন সেই সুরের খেলাতে।


শ্রোতা হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার। বিশেষ করে ভালো লাগত পশ্চিম দেশের গান।


জন্মেছিলেন তিনি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে অক্টোবর। বোম্বের এক ব্যবসায়ী পারসি পরিবারে। তাঁর বাবা ব্যবসায়ী হলে কি হবে, বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল ভদ্রলোকের। নানা বিষয়ের বই নিয়ে একটি সুন্দর লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন বাড়ির মধ্যে। কাজের অবসরে লাইব্রেরিতেই ডুবে থাকতেন তিনি।


এই পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা ভাবা কিন্তু ছোটোবেলার বিজ্ঞানের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেননি।


যথাসময়ে তাঁর স্কুলের পড়া শেষ হল। ভাবা সত্যিকারের সমস্যার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিজ্ঞানকে খুব একটা লাগে নি নাকি? ভালো লাগে আঁকা, কবিতাচর্চা এবং সংগীত? অবশেষে তাঁর বাবাই সব সমস্যার সমাধান করলেন। তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন বিলেতে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দিলেন।


হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা কিন্তু বেশিদিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক্লাস করেননি। নীরস কলকব্জা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে তার মোটেই ভালো লাগত না। মাঝপথেই তিনি এই পড়া ছেড়ে দিলেন। এলেন পদার্থবিদ্যার ক্লাসে।


১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে কেমব্রিজ থেকে পদার্থবিদ্যায় বি এ পাশ করলেন তিনি। তখন ভাবার মনে নতুন ভাবনার স্পন্দন ঘটে গেছে। না, আর কবিতা লেখা নয়, সংগীত-সাগরে অবগাহন করা নয়, এবার আমাকে একজন ব্যবহারিক পদার্থবিদ হয়ে উঠতে হবে, এমনটিই সংকল্প করেছেন ভাবা।


তখন পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ডির‍্যাক, পাউলি, হিজেনবার্গ, বন এবং শ্রয়া ডিংগার-এর মতো দিকপাল পদার্থবিদেরা। এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ডির‍্যাক।


ডির‍্যাকের মতবাদটিকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল সেদিনের সদ্য তরুণ হোমি জাহাঙ্গীরের ভাবার। কেমব্রিজে বিএ পড়তে পড়তেই তিনি ডির‍্যাকের গবেষণার প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কেমব্রিজের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে পদার্থবিদ্যার বই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত তাঁর।


১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেন। পরবর্তীকালে ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবাকে আমরা একজন বিশিষ্ট  পদার্থবিদ হিসেবে চিনেছি। ভাবতে অবাক লাগে, ছোটোবেলায় যিনি কবিতা লেখা আর গানের মধ্যেই জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছিলেন, তিনি হয়ে উঠলেন একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী! সত্যিই মানুষের জীবনে কখন কোন পরিবর্তন ঘটে আমরা তা জানতেই পারি না !


স্বাধীন ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভাবা একটি স্মরণযোগ্য নাম। তিনি ভারতের পরমাণুশক্তি কমিশনের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগের সচিব পদে মনোনীত হন। তাঁর প্রেরনাতেই ভারতের পরমাণু শক্তির উন্নয়নসংক্রান্ত গবেষণা শুরু হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের প্রথম পরমাণু শক্তি চুল্লি বা অ্যাটমিক রি-অ্যাক্টর।


মুম্বাই শহরের অদূরে তারাপুরে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় ভারতের প্রথম পরমাণু শক্তি কেন্দ্রটি। দু-বছর পর এখানেই গড়ে ওঠে প্লুটোনিয়াম প্ল্যান্ট। এইসব প্রয়াসের অন্তরালে ছিলেন ওই নিরলস সংগ্রামী-বিজ্ঞানী ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা।


এরই পাশাপাশি তিনি মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও ভারতের ভূমিকাকে উজ্জ্বলতর করেছেন। তাঁরই উদ্যোগে শুরু হয়েছিল তেজঃসৌরবিদ্যা এবং জীবাণুবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা। স্থাপিত হয়েছিল উৎকামন্ডের রেডিও টেলিস্কোপ।



১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে এক বিমান দুর্ঘটনাতে অকাল প্রয়াত হলেন এই মহান বিজ্ঞানী। ভারতীয় বিজ্ঞানী সাধনায় অক্ষয়কীর্তি স্থাপন করে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

ছোটবেলায় বিজ্ঞানে কোন আগ্রহ ছিল না পরমানু বিজ্ঞানীর - হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জীবনী ছোটবেলায় বিজ্ঞানে কোন আগ্রহ ছিল না পরমানু বিজ্ঞানীর - হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জীবনী Reviewed by Wisdom Apps on অক্টোবর ১৭, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.