তান্ত্রিকের ছেলে থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক - জোহানেস কেপলারের জীবনী

জোহানস কেপলার (জন্ম : ১৫৭১ খ্রী., মৃত্যু : ১৬৩০ খ্রী.)

তাঁকে বলা হয় বিশ্বের বিজ্ঞান সৌধের অন্যতম স্থপতি। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অবদান আজও আমরা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি। তিনি হলেন জোহানস কেপলার।
জন্মেছিলেন তিনি ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে, জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে উইল শহরে। ভাবতে অবাক লাগে, যে জোহান কেপলার আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক, তাঁদের পারিবারিক, পেশা ছিল ডাইনিতন্ত্র! তখনকার দিনে এই তন্ত্রটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হত। অন্ধবিশ্বাসের বিভীষিকাময় স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের মধ্যেই জোহান কেপলারের প্রথম শৈশবের দিনগুলি অতিবাহিত হয়।
তাঁর পিতা এবং পিতামহ ছিলেন কুখ্যাত তান্ত্রিক। মানুষের অজ্ঞতাকে মূলধন করেই তাঁরা অর্থ উপার্জন করতেন। কেপলারের ছোটবেলার দিনগুলির কথা ভাবলে কেমন যেন শিউরে উঠতে হয়। সে এক দারুন দুঃসময় ! চোখের সামনে কেপলার দেখতে পেতেন অন্ধকারে কেমন পাল্টে যাচ্ছে তাঁর আপনজনেদের চেহারা। তাঁর বাবা ও ঠাকুরদা ঢলঢলে কালো আলখাল্লা পরেছেন। মুখের উপর কঙ্কালের মুখোশ, দুটি দাঁত বেরিয়ে আছে গদন্তের মতো। তাঁরা চিৎকার করছেন। তাঁদের হাতে উদ্যত দন্ড। কোনো একটি ছেলেকে হয়তো ভুতে পেয়েছে। বাবা এবং ঠাকুরদা পালাক্রমে ছেলেটিকে আঘাত করছেন। তার মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠছে। মারতে মারতে ছেলেটিকে আধমরা করে দেওয়া হল। তবুও সে চুরির কথা স্বীকার করল না। এবার বাবা সর্বশেষ অস্ত্রটি প্রয়োগ করবেন। ভয়ে বিস্ময়ে জোহান কেপলার চোখ বন্ধ করেছেন। কিন্তু তবুও তাঁকে এই নারকীয় দৃশ্য দেখতে হবে। এইভাবেই নিজের স্নায়ুপুঞ্জকে আরও সাহসী ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। পরবর্তীকালে তাঁকেই তো এই পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করতে হবে। ছোট থেকে তাই তিনি নিজেকে এই পেশার উপযুক্ত করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। এটাই ছিল তাঁদের পরিবারের এক অলিখিত নিয়ম।
শেষ অস্ত্র হিসাবে কেপলারের বাবা কি করতেন শুনলে তোমরা অবাক হয়ে যাবে। কেপলারও ভীত চোখে প্রত্যক্ষ করতেন, তার বাবা দুটো ইস্পাতের দন্ড নিয়ে এলেন। গনগনে আগুন-আঁচে তাদের উত্তপ্ত করলেন। তারপর সটান ঢুকিয়ে দিলেন চোর সন্দেহে ধরে আনা ছেলেটির চোখের মধ্যে। এক মুহূর্তে ছেলেটি অন্ধ হয়ে গেল। চোখের মনিটা গেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সমবেত জনতা হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। বেচারি জোহান, অসহায় ব্যর্থতায় চোখ বন্ধ করতেন। বিড়বিড় করে অস্ফুট আর্তনাদের মধ্যে ক্ষমা প্রার্থনা উচ্চারণ করতেন। কেউ তার কথা শুনতে পেত না। বেজে উঠত ঢাক, কাড়া-নাকাড়া। জিতে গেছেন! জিতে গেছেন তাঁর ডাইনি বাবা ! ছেলেটি কবুল করেছে - 'হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি।' যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে বলছে, 'আমি চুরি করেছি যবের আটা। আমাকে যা শাস্তি দেবার দিন। এভাবে আর কষ্ট দেবেন না।'
শহরে প্রচুর প্রতিপত্তি ছিল জোহান কেপলারের বাবার। সকলেই তার দিকে ভয়মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে থাকত। পথে যেতে যেতে মাঝেমধ্যেই তিনি রাজার মতো খামখেয়ালিপনা প্রদর্শন করতেন। যা খুশি তাই তুলে নিতেন। লোক কিছু মনে করত না। বরং ভাবত, ওই বিখ্যাত তান্ত্রিক আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, এতেই আমার চোদ্দো পুরুষ ধন্য হয়ে গেছে !
কোথা থেকে কোথায় এলেন জোহান কেপলার ! তুকতাক আর জরিবুটির ভাঁওতা থেকে প্রগতিশীল বিজ্ঞানের প্রশস্ত শরনি - কিভাবে ঘটল এই উত্তরণ? এ এক অদ্ভুত কাহিনী ! ছোটবেলা থেকে কেপলার রোগে ভুগতেন। ভীষণ রুগ্ণ ও দুর্বল ছিলেন তিনি। চার বছর বয়সেই পরলোক যাবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। গুতিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। হয়তো ভবিষ্যতে তাঁকে দিয়ে অনেক বড়ো কাজ করানো হবে বলেই, বিধাতা পুরুষ সে-যাত্রা তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এই অস্বাভাবিক রোগমুক্তির পর থেকেই কেপলারের মানসিকতার জগতে দারুন পরিবর্তন ঘটে যায়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, বোধহয় তাঁর নবজন্ম হয়েছিল।
পরিবারের লোকেরা তার পড়াশোনার প্রতি বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু শিশু জোহান কেপলার পড়াশোনাতে ভীষণভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এই সময়ে আরমেটবার্গের ডিউক নানা জায়গাতে শিশুশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় খুলেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, ছেলেদের ধর্ম বিষয়ে সচেতন করে তোলা। তা না হলে ভবিষ্যতে সৎ, শোভন নাগরিক পাওয়া সম্ভব হবে না। অবশ্য এই বিদ্যালয় গুলিতে ধর্মশাস্ত্রের পাশাপাশি বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলিও পড়ানো হত।
এমনই একটি স্কুলে একদিন ভর্তি হয়েছিলেন কেপলার। মা-বাবাকে কোনো কথা জানাননি, পাছে তাঁরা বাধার সৃষ্টি করেন।
সেই প্রথম ডাইনি বাড়ির অন্ধকার থেকে বাইরের প্রকৃতির মুক্ত জগতে পা রাখলেন জোহান কেপলার। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন সূর্যের আলোককনার দিকে। চারপাশে আলোর এত উৎসার, তবে আমাদের বাড়িটি এখনও মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের মধ্যে পড়ে আছে কেন?
ডিউকের স্থাপিত স্কুলে এসে কেপলার নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন। প্রকৃতির রহস্যকে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিশ্লেষণ করছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হল। কুড়ি বছর বয়সে তিনি টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এখানে এসেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কোপার্নিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্যের সঙ্গে। কোপার্নিকাসকে তিনি চোখে দেখেননি, কিন্তু কোপার্নিকাসই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রচ্ছন্ন শিক্ষাগুরু।
তখনও কোপারনিকাসের মতবাদকে আইনগতভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়নি। টলেমির সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদটিকেই সকলে নে করেন অভ্রান্ত।
টলেমি বলেছিলেন, 'পৃথিবী স্থির, সূর্য তার চারদিকে ঘোরে।' কোপার্নিকাস বলেছিলেন, 'আকাশে সূর্যকে কেন্দ্র করে সবকিছু ঘোরে, এমনকি পৃথিবীও।' কোপারনিকাসের এই কথার সমর্থন বাইবেলে নেই। সুতরাং, এটি ধর্মবিরুদ্ধে এই অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হয়।
কেপলারের মনের বাসনা ছিল ভবিষ্যতে তিনি একজন ধর্মযাজক হবেন। কেন যে তিনি এই বাসনা পোষণ করেছিলেন, তার আসল কারণ আমরা জানিনা। কিন্তু দেখা গেল, ক্রমশই তার মত পরিবর্তিত হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন এই শাশ্বত সত্য। তা হল, এইভাবে ধর্মযাজক হলে কোনো লাভ হবে না। মানুষকে আরো বেশি শোষণ করা হয়। বস্তাপচা ধর্মের বাণী কপচানো হয়। তার থেকে অনেক ভালো হবে যদি জোহান কেপলার বিজ্ঞানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।
ইতিমধ্যে কোপারনিকাসের মতবাদকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন তিনি। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন যে, টলেমিকে এবার সরে যেতে হবে। কোপারনিকাসকে তাঁর প্রাপ্য জায়গা ছাড়তেই হবে।
টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি কেটে গেল। শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে গেলেন জোহান কেপলার। শুরু হল নতুন পথে পরিভ্রমন। কলেজে পড়বার সময়, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে 'দি হিস্ট্রি অফ দ্য ইউনিভার্স' নামে একটি বিতর্কিত বই লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন কেপলার।
এই বইটি পড়ে ছুটে এসেছিলেন দুজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও এবং টাইকো ব্রাহে। তরুণ বিজ্ঞানীর গবেষণাকার্যের ধরন দেখে তাঁরা খুব খুশি হয়ে ছিলেন। তারা বিঝতে পেরেছিলেন এইভাবেই নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানের আধুনিকতম চিন্তাভাবনাতে আত্মনিয়োগ করবেন।
কিন্তু কেপলারের বিরুদ্ধবাদীরা সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। তাঁর বইয়ের বক্তব্য বিষয়ে ধর্মবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ দেখে পাদ্রী সমাজে উষ্মা ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
বিপদের গন্ধ পেয়ে কেপলার শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। নিদারুন অনিশ্চয়তার মধ্যে তার দিন কাটছে। দেখা দিয়েছে তার আৰ্থিক অনটন। গবেষণা চালাবেন কি করে স্থির করতে পারছেন না। এই সময় ভগবানের আশীর্বাদের মতো তাঁর ওপর নেমে এল টাইকো ব্রাহের সহানুভূতি। ব্রাহে তাঁকে সহকারী হিসেবে মনোনীত করলেন।
ব্রাহে এবং কেপলার দুজনেই সুদূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তাদের মনে স্থির বিশ্বাস ছিল, মানুষের জীবনের ভালোমন্দের উপর এই গ্রহ-নক্ষত্রের অসীম প্রভাব আছে। তারাই প্রথম আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা করেছিলেন। ঘোষনা করেছিলেন - 'জন্ম মুহূর্ত থেকে মৃত্যু অব্দি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে দূর আকাশের ওই নক্ষত্রদল !'
কেপলার ঘোষণা করেছিলেন 'ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র কনা থেকে বিরাট ব্রহ্মান্ড - সবই একই সুরে বাধা।' তখনকার দিনে এ ধরনের মতবাদ প্রকাশ করা যথেষ্ট সাহসিকতার বিষয় ছিল।
ব্রাহের মৃত্যুতে জোহান কেপলার অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন। ব্রাহে ছিলেন তাঁর জীবনের দুর্দিনের পথ প্রদর্শক। ঈশ্বরের একটি বিশেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য বোধহয় তারা দুজন এই পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়েছিলেন। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
শেষ অব্দি কেপলারের সঙ্গে গ্যালিলিও এর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। কেপলার বিশ্বাস করতেন যে, কুষ্টি এবং ঠিকুজি মানুষের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গ্যালিলিও এই ব্যাপারে চিয়েন চরম অবিশ্বাসী। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তারপর আর কখনো তাদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটেনি। গ্যালিলিও কিন্তু তার তরুণ বন্ধুকে মনে রেখেছিলেন। দূরবীন যন্ত্র আবিষ্কার করে যে কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর কাছে তা পাঠিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কেপলার ছিলেন অন্যতম।
১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটান্ন বছর বয়সে বরেণ্য বিজ্ঞানী কেপলারের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে গিয়েছিল।
তান্ত্রিকের ছেলে থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক - জোহানেস কেপলারের জীবনী তান্ত্রিকের ছেলে থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক - জোহানেস কেপলারের জীবনী Reviewed by Wisdom Apps on সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.