শিবনিবাস ভ্রমণ গাইড ও ইতিহাস । কি কি দেখবেন ? কবে যাবেন ?

  শিবনিবাস ভ্রমনের এই ভিডিওটি দেখে নিন - খুঁটিনাটি সব জানতে পারবেন । YouTube Link

আজকের ডেসটিনেশন নদিয়ার শিবনিবাস ।  প্রথমে জেনে নিন কীভাবে শিবনিবাস যাবেন ?
দুই দিক দিয়ে আসা যায় শিবনিবাসে , শিয়ালদা থেকে গেদে লোকালে করে চলে আসুন মাজদিয়া, সময় লাগবে ২ ঘন্টা ৩০মিনিট  । মাজদিয়া স্টেশন থেকে টুক্টুকি করে অল্প সময়েই পৌঁছে যাবেন শিবনিবাস । অথবা কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগরে চলে আসুন । স্টেশন থেকে টুক্টুকি করে কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ডে আসতে হবে , ভাড়া নেবে ১০ টাকা । কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ড থেকে মাজদিয়া যাওয়ার 

বাসে চেপে শিবনিবাস আসতে পারবেন ভাড়া পড়বে ২০ টাকারও কম । 
বাসে এলে শিবনিবাস মোড়ে নামতে হবে , মোড় থেকে মন্দির পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে । এই পথে যাওয়ার সময় একটি বাশের ব্রীজ বা সাঁকো পার হতে হবে । সাঁকো পার করে একটু হেঁটে গেলেই মন্দির  । আমরা মন্দির যাওয়ার পথে  এক সাধু বাবার ছাউনি ঘরের নীচে রাখা এই বাচ্চা হনুমানটিকে দেখেছিলাম , মা হারা এই ছোট্ট প্রানীটি এখন এনাদের স্নেহেই বড় হচ্ছে । ছাউনি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেই মন্দির দেখতে পাবেন । 
 যদি আপনারা ট্রেনে বা নিজস্ব গাড়িতে আসেন তাহলে শিবনিবাস মোড়ে একটি সুন্দর নীল সাদা ব্রীজ দেখতে পাবেন , এই ব্রীজের নীচ দিয়ে বয়ে গেছে চুরনি নদী । মন্দিরে যাওয়ার আগে ব্রীজের উপর কিছুক্ষন দাড়িয়ে আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন । ছবি তোলার জন্য এটা বেশ ভালো জায়গা । ব্রীজ পার করে এগিয়ে গিয়ে বা হাতে মন্দির যাওয়ার পথ পাবেন ।

মন্দিরের কাছাকাছি পৌছালেই চোখে পড়বে সুউচ্চ " রাজরাজেশ্বর " মন্দিরটি । সাধারন মানুষের কাছে এটি " বুড়োশিবের মন্দির " নামেই খ্যাত । ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে অর্থাৎ ১৬৭৬ শকাব্দে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার প্রথম স্ত্রী'র জন্য এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন । উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত এই  মন্দিরটির  চুড়া সমেত উচ্চতা ১২০ ফুট।  খাড়া দেওয়ালের প্রতি কোনে মিনার ধরনের আটটি সরু থাম আছে । প্রবেশদ্বারে খিলান ও অবশিষ্ট দেওয়ালে একই আকৃতির ভরাটকরা নকল খিলান দেখতে পাবেন ।  মন্দিরের ভেতর পূর্ব ভারতের সবথেকে বড় কষ্টিপাথর নির্মিত শিবলিঙ্গ দেখতে পারবেন ।  এই শিবলিঙ্গের উচ্চতা ৯ ফুট আর বেড় ২১ ফুট ১০ ইঞ্চি। এই সুবিশাল শিবলিঙ্গের নাম 'রাজরাজেশ্বর'। শিবলিঙ্গের মাথায় জল , দুধ ইত্যাদি


ঢালবার জন্য সিঁড়ি আছে । দর্শনার্থীরা একদিক দিয়ে উঠে জল ঢেলে অন্যদিক দিয়ে নেমে শিবলিঙ্গ প্রদক্ষিন করে ফেরত আসতে পারেন ।  মন্দিরের আশেপাশে কয়েকটি দোকান আছে , পুজার সামগ্রি কিনে নিয়ে পুজো দিতে পারবেন ।  প্রাচীন কাল থেকে মার্চ মাসের ভীম একাদশি থেকে শুরু হয় মেলা, চলে শিবরাত্রি পর্যন্ত। এই স্থানটির একটি ইতিহাস আছে । জানা যায় এক সময় এখানে নসরত খাঁ নামে দুর্ধর্ষ এক ডাকাত ছিল । তার নামে এই জায়গার নাম ছিল নসরত খাঁর বেড়  । মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই ডাকাতকে দমন করতে মাজদিয়ার এক গভীরে অরন্যে উপস্থিত হন । ডাকাত দমনের পর তিনি এক রাত বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকালে নদীর জলে মুখ ধুতে যান । এই সময় নদীর স্রোতে একটি রুইমাছ লাফিয়ে এসে রাজার পায়ের কাছে পরে । এই দৃশ্য দেখে ক্রিশ্নরাম নামে মহারাজের আত্মীয় বলেন - " এই স্থানটি অত্যন্ত মনোরম , তার উপরে রাজভোগ্য সামগ্রী নিজে নিজেই রাজার কাছে উপস্থিত হচ্ছে , এই স্থানে বাস করলে মহারাজের নিশ্চয়ই উপকার হবে । " । তৎকালীন বর্গীদের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য মহারাজ একটি ভালো জায়গা খুঁজছিলেন , এই স্থানটি মহারাজের খুব পছন্দ হয় । তিনি নদিয়ার রাজধানী সাময়িকভাবে এখানে স্থানান্তরিত করেন । চুরনি নদীকে নির্দিষ্ট ভাবে কেটে এই স্থানকে সুরক্ষিত করা হয় ,আর এই স্থানের নাম বদলে শিব ঠাকুরের নামে নতুন নাম রাখা হয় শিবনিবাস । এই খানে মহারাজা ১০৮ টি মন্দির ও একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন । বর্তমানে মাত্র ৩ টি মন্দির অবশিষ্ট আছে । 
রাজরাজেশ্বর মন্দিরের পূর্বদিকে ৬০ফুট উঁচু চার চালার ২য়  মন্দিরটি দেখতে পাবেন ।মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার ২য় স্ত্রী'র জন্য এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন । এটিকে 'রাজ্ঞীশ্বর' মন্দির বলে । এর ভিতরের শিবলিঙ্গটি ৭ফুট উঁচু । এটিও তৈরি হয়েছিল ১৭৫৪ সালে। এই মন্দিরটি সব সময় খোলা পাওয়া যায় না । এর পাশে একটি রাম-সীতার মন্দির রয়েছে। পশ্চিমমুখী এই মন্দিরটি ভিত্তিবেদির উপর অবস্থিত , চার চালার এই মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুট । এই মন্দিরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত আছেন কালো পাথরের রামচন্দ্র, অষ্টধাতুর দেবী সীতা সাথে অনুজ লক্ষণ। এছাড়াও শিব, কালী, গনেশ, সরস্বতী ও কৃষ্ণের প্রাচীন মূর্তি এখানে প্রতিষ্ঠিত । এই মন্দির প্রাঙ্গনে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ । এই মন্দিরটি তৈরি হয় ১৭৬২ সালে।  মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসে অগ্নীহোত্রী বাজপেয়ী যজ্ঞ সমপন্ন করেছিলেন । এই যজ্ঞে কাশি , কাঞ্চি প্রভৃতি স্থানের বিজ্ঞ পণ্ডিতরা এসেছিলেন । তারা মহারাজকে  " অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী " আখ্যা দেন । সেই সময় থেকেই শিবনিবাসকে তীর্থস্থান কাশির ন্যায় মর্যাদা দেওয়া হয় । প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার লক্ষাধিক মানুষ নবদ্বিপের গঙ্গা নদী থেকে জল নিয়ে ৪২ কিলোমিটার হেঁটে শিবনিবাসের বুড়োশিবের মাথায় ঢালে । 
এছাড়াও মন্দির গুলির কিছু বিশেষত্ব আছে । প্রতিটি মন্দিরের মাথায় কয়েকশ ফোকর দেখতে পারবেন , ফোকরগুলিতে কয়েকশ টিয়াপাখি বাসা করে। তাদের , বসা , উড়ে যাওয়া ,মারা মারি করা দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে যাবে ।  ১৮২৪ সালে বিশপ হেয়ার সাহেব নদিপথে ঢাকা যাওয়ার সময় এই মন্দির ও রাজপ্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হন এবং এই মন্দির গুলি সমন্ধে তার একটি লেখা ১৮২৮ সালে লন্ডনের জার্নালে প্রকাশিত হয় । তিনি রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারটিকে ক্রেমলিলের প্রধান তোরণের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন " সেই বিস্তীর্ণ প্রাসাদের মনোরম নির্মাণ শৈলী তাঁকে কনওয়ে ক্যাসেল ও বোলটন অ্যাবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় "। এই মন্দিরগুলিতে কোনো টেরাকোটার কাজ না থাকলেও এর গঠনশৈলী বাংলার মন্দিররীতিতে এক উল্লেখযোগ্য সংগজোজন । বাংলার বুকে শিবনিবাশের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম । মন্দির ছাড়াও শিবনিবাসে একটি রেশম খামার আছে , সময় হলে দেখে আসতে পারেন । রাম মন্দিরের গা ঘেঁসে পাকা রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে  এই রেশম খামারটি দেখতে পাবেন । 
তুঁত গাছের বাগানে ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আশেপাশে রেশম কীট প্রতিপালন দেখতে পারে । বিশেষ অনুমতি নিয়ে গুটি থেকে রেশম তৈরির পদ্ধতিও দেখতে পারবেন । 

মন্দির ও রেশম খামার দেখে আশেপাশের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে মাজদিয়া বা কৃষ্ণনগর স্টেশনে ফেরত চলে যান । শিয়ালদহ বা লালগোলা যাওয়ার অনেক ট্রেন পেয়ে যাবেন ।  

শিবনিবাস ভ্রমণ গাইড ও ইতিহাস । কি কি দেখবেন ? কবে যাবেন ? শিবনিবাস ভ্রমণ গাইড ও  ইতিহাস । কি কি দেখবেন ? কবে যাবেন ? Reviewed by Wisdom Apps on আগস্ট ১২, ২০১৯ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.