তাঁতির ছেলে হয়ে উঠলো জগতসেরা বিজ্ঞানী , পড়ুন জন ডালটনের জীবনী

জন ডালটন (জন্ম : ১৭৬৬ খ্রি. , মৃত্যু : ১৮৪৪ খ্রি.)

এবার এক তাঁতী পরিবারের গল্প বলি। তোমরা কি কখনও ফুলিয়াতে গেছ? নিদেনপক্ষে সমুদ্রগড় অথবা বেগমপুর। যদি যাও, তাহলে দেখবে, সেখানকার জীবন একেবারে অন্য খাতে বইছে। সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি শুধু মাকুর আওয়াজ, টানা আর পোড়েনের শব্দ। এর বাইরে যে আরো একটা পৃথিবী আছে, সে-খবর রাখেন না ওখানকার মানুষজন। ওনারা তাঁত বুনে চলেছেন। তৈরি করছেন মানুষের পরিধেয় হাজার সামগ্রী।
এমনই এক তাঁতী পরিবারে জন্মেছিলেন জন ডালটন। যিনি পরবর্তীকালে প্রমানুবাদের প্রবর্তক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। জন্মেছিলেন তিনি ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ইগলস ফিল্ড নামে এক অখ্যাত গ্রামে।
যে পাড়াতে তিনি জন্মেছিলেন, সেটা ছিল তাঁতিদের পাড়া। তাঁত বুনে জীবন নির্বাহ করাই ছিল ওই পাড়ার মানুষদের একমাত্র কাজ। পুরুষানুক্রমে এঁরা ছিলেন নিরক্ষর। নিজের নাম সই করতে পারতেন না। লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পূর্ন সম্পর্কশূন্য হয়ে জীবন কাটাতেন।
কারোর হাতেই পয়সাকড়ি বিশেষ থাকত না। সকলেই ছিলেন হতদরিদ্র। খাবার সংস্থান করতেই দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যেত। অবসর বিনোদনের কোনো সুযোগ ছিল না। ওরই মধ্যে কি একটা রোগ মহামারি আকার ধারণ করত। তখন ওঝাকে ডাকতে হত। তিনি এসে ঝাড়ফুঁক করতেন। নাকের ভিতর লঙ্কাপোড়ার ধোঁয়া ঢুকিয়ে দিতেন। হ্যাঁচ্চ হ্যাঁচ্ছ করে জীবন বেরিয়ে যেত। 
সে এক ভয়ংকর দিন ! অভিশপ্ত রাত ! এভাবেই জন ডালটনের ছোটোবেলা কেটে যায়।
ডালটনও ভেবেছিলেন তাঁতি হবেন। সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন বাবাকে সাহায্য করতে। কিন্তু এরই পাশাপাশি আর-একটি কাজ তিনি করেছেন যত্নের সঙ্গে, যা সে যুগের কেউ ভাবতেই পারতেন না।
কি সেটা? পড়াশোনা। লেখাপড়ার প্রতি সহজাত আগ্রহ ছিল জন ডালটনের। সেই আগ্রহে নিতান্ত শৈশবকালেই স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। স্কুলটি ছিল পাশের গ্রামে। অনেকটা পথ হাঁটতে হত তাকে। যখন তিনি বই বগলে করে স্কুলে যেতেন, সমবয়সীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন তাঁর দিকে। আর ভাবতেন, জনের কি মাথা খারাপ হয়েছে? বিদয়ের জাহাজ হয়ে কি হবে?
আশ্চর্য মেধা ছিল জন ডালটনের। অতি অল্প সময়ে তিনি সহপাঠীদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কথিত আছে, বিদ্যালয়ে পড়বার সময় নিজের চেষ্টাতে গ্রিক এবং লাতিনের মতো দুরূহ ভাষাদুটিকে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। তাই দেখা গেল, এগারো বছরের বালক জন ডালটন গড়গড় করে গ্রিক কবিতা আবৃত্তি করছেন। গ্রিক নাটকের সংলাপ বলছেন। লাতিন ভাষায় লেখা কঠিন মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। তখনই তাঁর চারপাশে ভিড় জমে যেত। গুনমুগদ্ধ মানুষেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন জন ডালটনের মুখের দিকে। অনেকে ভাবতেন, তিনি বোধহয় রূপকথার এক মহানায়ক। কেউ কেউ আবার তাঁর সঙ্গে অবতারবাদ জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের চোখে জন ডালটন নতুন যুগের যীশুখ্রিস্ট।
ছোটবেলায় বিজ্ঞান এবং অঙ্কই বেশি ভালো লাগত তাঁর। যখন বয়স তাঁর বারো, তখন একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন জন ডালটন। নিজেই স্থির করলেন, তাঁতি পাড়ার খেলার সঙ্গীদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। আর কতদিন এরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে মুখ গুঁজে পড়ে থাকবে?
নিজেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে ফেললেন জন ডালটন। নামেই কিন্ডারগার্টেন, বয়স্কদেরও শিক্ষা দিতে থাকলেন সেখানে। তখ। থেকেই জন ডালটন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সব মানুষকে সাক্ষর করে তুলতে হবে। নিরক্ষর জীবন বড্ড অপমানের। প্রতি মুহূর্তে ঠকবার ভয় থাকে। যে জীবনকে আমরা শতবার ধিক্কার জনাব।
বাবর কাজে সাহায্য করতে হচ্ছে, স্কুলে যেতে হচ্ছে, পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে, আর তারই পাশে সন্ধ্যেবেলা আবার নিজে হাতে তৈরি ওই স্কুলে এসে পড়াতে হচ্ছে। এইভাবে সকাল থেকে রাত অব্দি নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত জন ডালটনকে।
প্রথমদিকে পাড়ার সকলে ডালটনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বিদ্যাশিক্ষার এই ব্যাপারটিকে তাঁরা ভালো মনে গ্রহণ করতে পারেননি। অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল ডালটনের বিরুদ্ধে। শেষপর্যন্ত সকলেই তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। প্রত্যেকেই শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
অঙ্কই ভালোবাসতেন ডালটন। কঠিন কঠিন অঙ্ক কষতে কষতে রাত কেটে যেত। তবুও এতটুকু ক্লান্তি ছিল না তার।
আঠারো বছর বয়সেই ছোটখাটো বিজ্ঞান মডেল তৈরি করতে থাকেন। সেসব নিয়ে আপন খেয়ালেই একটির পর একটি পরীক্ষা চালাতে থাকেন। তারপর একটি খাতায় পরীক্ষার বিভিন্ন অবস্থা ও সিন্ধান্তের বিবরণ লিখতে থাকেন।
বিখ্যাত শিল্পনগরী ম্যাঞ্চেস্টার। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই ডালটন এম এস সি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন একজন অধ্যাপক হিসেবে।
পরবর্তী কালে জন ডালটন পরমাণুবাদতত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনিই প্রথম বলেন যে, প্রতিটি মৌলিক পদার্থ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কনা দিয়ে গঠিত। এই কনাগুলি অবিভাজ্য। প্রত্যেকেই পরস্পরের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট ব্যবধানে অবস্থান করছে। তিনি আরো বলেছিলেন, এই কনাকে ভাঙা কিংবা গড়া যায় না। প্রত্যেকটি মৌলিক পদার্থের কনাগুলির ওজন এবং ধর্ম এক।
গ্রিক ভাষা ভালোভাবে জানতেন বলে, প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিলন তিনি। গণিত বিজ্ঞানী ডেমোক্রিটাসের মতামতকে আশ্রয় করেই ডালটন তাঁর পরমাণুতত্ত্ব প্ৰতিষ্ঠা করেন। ডেমোক্রেটিস অবিভাজ্য কনাগুলির নাম দিয়েছিলেন 'অ্যাটমস'। এই গ্রিক শব্দটির অর্থ 'অবিভাজ্য'। ডালটন এই শব্দটিকে গ্রহণ করলেন 'স' অক্ষরটিকে বাদ দিয়ে। জন্ম হল 'অ্যাটম' এর।
জীবদ্দশাতেই তিনি এক বিশিষ্ট অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সারাজীবনে অনেক সম্মান ও পুরুষ্কার লাভ করেন। ফ্রান্সের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমী তাঁকে মাননীয় সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।
১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে এই নিরভিমানী মৃত্যু হয়।
তাঁতির ছেলে হয়ে উঠলো জগতসেরা বিজ্ঞানী , পড়ুন জন ডালটনের জীবনী তাঁতির ছেলে হয়ে উঠলো জগতসেরা বিজ্ঞানী , পড়ুন জন ডালটনের জীবনী  Reviewed by Wisdom Apps on অক্টোবর ১০, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.