আর্কিমিডিসের জীবনী ও আর্কিমিডিসের তত্ত্ব - পড়ে নিন

আর্কিমিডিস (খ্রীঃপূঃ২৮৭-খ্রীঃপূঃ২১২)

প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের সাইরাকিউজ নামে একটি রাজ্য ছিল। এই দেশে খ্রীস্টপূর্ব ২৮৭ আব্দে জন্ম হয় আর্কিমিডিসের। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতিরবিজ্ঞানী ফিডিয়াস। বাবার মতই আর্কিমিডিসও ছিলেন আসাধারণ পণ্ডিত। তাঁর খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। দিনের পর দিন তিনি কাটিয়ে দিতেন বই পড়ে আর অঙ্ক কষে। আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়ামে বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে তিনি শিক্ষা লাভ করেন।  আর্কিমিডিসের বন্ধু ছিলেন সাইরাকিউজের রাজা হিয়েরো। 

রাজা হিয়েরো আর্কিমিডিসকে মাঝে মাঝেই বলতেন "কি যে দিনরাত বই পড়। লোকেতো তোমায় কদর দেয় না। মানুষের কাজে লাগে এরকম কোন যন্ত্র বানিয়ে সবাইকে যদি তাক লাগিয়ে দিতে পারো তবেই বুঝব তুমি একটা পণ্ডিতের মতো পণ্ডিত!" রাজার কথা তো আর আর্কিমিডিস ফেলতে পারবে না, তাই নানারকম স্ক্রু, জল তুলবার কপিকল, পাখা টানবার দেয়ালে লাগানো চাকার পুলি, এসব তো আবিস্কার করলেনই, আবার অঙ্ক কষার সুবিধার জন্য গোলক, পিরামিড, শঙ্কু প্রভৃতি বস্তুর ঘনফল ও ক্ষেত্রফলও বের করলেন। রাজা তো খুব খুশী।

রাজা হিয়েরো একবার এক স্যাকরার কাছে একটি সোনার মুকুট তৈরি করতে দিয়াছিলেন। মুকুটটা নির্দিষ্ট দিনে স্যাকরা রাজার হাতে তুলে দিলেন। মুকুটটি দেখেতে চমৎকার হয়েছে। কিন্তু রাজার মনে সন্দেহ হল স্যাকরা বুঝি সোনা চুরি করে খাদ মিশিয়েছে।

তাঁর সন্দেহ সত্যি কিনা তা মুকুট ভেঙে পরীক্ষা করলেই হত। কিন্তু মুকুটটা এতই সুন্দর দেখতে হয়েছে যে সেটা ভাঙতে মন চাইলে না রাজার। তাহলে কে তাঁর সন্দেহ মেটাবেন ? রাজার মানে পড়ল বন্ধু আর্কিমিডিসের কথা। বন্ধুকে ডেকে তিনি বললেন 'মুকুটটা না ভেঙে সোনায় খাদ মেশানো আছে কিলা জানাও'। মুকুট না ভেঙে যে কি করে খাদের পরিমান বের করবেন তা তো ভেবেই পেলেন না আর্কিমিডিস। কিন্তু একে বন্ধু তায় রাজার কথা, সে কি আর এককথায় নাচক করা যায় ! তাই বললেন 'কয়েকটা দিন সময় পেলে এর একটা উপায় হয়ত খুঁজে পাব।' রাজা বললেন, 'বেশ। তবে উপায় না খুঁজে পেলে রক্ষা নেই তোমার।'

কয়েকদিন কেটে গেল। উপায় যে কি খুঁজে বের করবেন মাথায় আসে না আর্কিমিডিসের। খালি ভাবেন যদি উপায় না পাই তবে আর রক্ষে নেই। সর্বক্ষণ একই চিন্তা তাঁর মাথায়। অন্যমনস্ক হয়েই খান, ঘুমনো, স্নান করেন। 

আর্কিমিডিস স্নান ঘরে ছিল একটি জল ভরতি স্নানের টাব। রোজ সেখানে নেমেই স্নান করতেন তিনি। একদিন মুকুটের কথা ভাবতে ভাবতে স্নানের টবে নেমেছেন। সেদিন টবটা ছিল জলে পরিপূর্ণ। যেই তিনি সেই টবে নামলেন অমনি বেশ কিছুটা জল উপচে মেঝেতে পড়ে গলে। সেই ঘটনা দেখে বিদ্যুৎ চমকের মত তাঁর হঠাত মনে হল জলপূর্ণ টবে তিনি নামলেন বলেই জল উপচে পড়ল, তাহলে জলপূর্ণ পাত্রে কোনো বস্তুকে ডোবাল নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জল উপচে পড়বেই। এই উপচে পড়া জলের ওজন আর বস্তুর ওজনের তুলনা করলেই বস্তুর ঘনত্ব পাওয়া যাবে। এভাবে হঠাৎ মুকুটে খাদ মেশানো আছে কিনা তাঁর উপায় বের  করার পথ খুঁজে পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন, স্নানের কথা ভুলে গেলেন তিনি। ঐ ভিজে অবস্থাতেই তিনি 'ইউরেকা ইউরেকা' বলতে বলতে ছুটলেন রাজসভার দিকে।

রাজসভায় গিয়ে আর্কিমিডিস রাজাকে বললেন সেই মুকুট, একটি জল ভর্তি পাত্র এবং কিছু পরিমান খাঁটি সোনা দিতে। এবার তিনি সোনার মুকুটটিকে নিয়ে ওজন করে তারপরে সেটিকে জলে ডুবিয়ে তার অপসারিত জলের ওজন নিলেন এবং ঐ দুই ওজনের তুলনা করে ঘনত্ব বের করলেন মুকটির। এবার ঐ খাঁটি সোনাকে ওজন করে, জলে ডুবিয়ে তার অপসারিত জলের ওজন করে সোনার ঘনত্ব বের করলেন। এভাবে তিনি খাঁটি সোনার ঘনত্বের সাথে মুকুটের সোনার ঘনত্বের তফাত দেখিয়ে প্রমান করে দিলেন যে মুকুটটিতে খাদ মেশানো আছে। 

মুকুটের সমস্যা সমাধানের থেকেই আর্কিমিডিস আবিস্কার করলেন এক সুত্র। এই সুত্র থেকে জানা যায় কোন বস্তুকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে জলে বা অন্য কোন তরলে নিমজ্জিত করলে বস্তু তার নিজ আয়তনের সমান জল বা তরল অপসারন করে। নিমজ্জিত করার ফলে বস্তুর যে পরিমাণ ওজন হ্রাস হয়, অপসারিত জলের ওজন ঠিক ততখানি। এই বিখ্যাত সুত্রকে বলে আর্কিমিডিসের সুত্র।

আর্কিমিডিস এভাবে তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিতে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান চর্চার নানান উন্নিতি ঘটিয়েছিলেন। রোমান সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করাছিলেন তাঁর জন্মভূমি সাইরাকিউজকে।

কিন্তু তাঁর বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রোমান সেনাপতি মার্সেলাস দীর্ঘ আটমাস ধরে আক্রমন ও অবরোধ চালিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ২১২ অব্দে সাইরাকিউজ দখল করেন। 

মার্সেলাস শুনাছিলেন বিখ্যত পন্ডিত আর্কিমিডিসের নাম। তাই সৈন্যদের নগর লুঠ করার সম্মতি দিলেও বলে দিয়েছিলেন তারা যেন আর্কিমিডিসের কোন ক্ষতি না করে। সৈন্যরা তো আর আর্কিমিডিসের চিনত না। তাই শহরের লোকেদের ধরে ধরে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করছিল তারা। এমন সময় প্রায় পঁচাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ লোককে বলির ওপর ছক কাটতে দেখে তারা জিজ্ঞাসা করে আপনি কি আর্কিমিডিস? কিন্তু আর্কিমিডিস তখন তাঁর গবেষণায় এতই ডুবে গেছিলেন যে হাত তুলে তাদের বিরক্ত করতে বারন করলেন। সৈন্যরা সকলের ওপর কতৃত্ব করতে অভ্যস্ত। কোন এক পাগল বুড়োর কথা তারা মানবে কেন ? সঙ্গে সঙ্গে আর্কিমিডিসের মাথা তাঁর দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
এখবর শুনে দুঃখে-লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গিয়েছিল সেনাপতি মার্সেলাসের। তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই তিনি আর্কিমিডিসকে অতিযত্নে কবরে শায়িত করে তাঁর কবরের ওপর একটি সুন্দর সমাধি তৈরি করেছিলেন।

আর্কিমিডিসের জীবনী ও আর্কিমিডিসের তত্ত্ব - পড়ে নিন আর্কিমিডিসের জীবনী ও আর্কিমিডিসের তত্ত্ব - পড়ে নিন Reviewed by Wisdom Apps on সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.