বইয়ের দোকানের কর্মচারী থেকে - পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী । মাইকেল ফ্যারাডের জীবনী

মাইকেল ফ্যারাডে (জন্ম : ১৭৯১ খ্রি. মৃত্যু : ১৮৬৭ খ্রি.)

১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ২২শে সেপ্টেম্বর জন্ম হয়েছিল মাইকেল ফ্যারাডের। জন্মেছিলেন তিনি ইংল্যান্ডের নেউইংটন অঞ্চলে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র কর্মকার।
ছোটোবেলা থেকেই পিতার কারখানাতে ঘোরাফেরা করতেন মাইকেল ফ্যারাডে। কিভাবে কামরার লোহা পেটাচ্ছে, তা দেখতেন অবাক বিস্ময়ে। শিশুসুলভ উৎসাহে একদিন ঘোষণা করেছিলেন - 'বাবা, বড়ো হয়ে আমিও একজন কর্মকার হব। দেখো, সেদিন তোমাকে আর টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না।'
হয়তো কর্মকার হওয়ার স্বপ্ন সফল হয়নি মাইকেল ফ্যারাডের, কিন্তু তিনি যা আবিষ্কার করেছিলেন, তা বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল সাদরে বরণ করে নিয়েছেন। তিনি এনেছেন ডায়নামো, বিশ্বের শিল্পক্ষেত্রে যা একটি বিপ্লব সংঘটিত করে। মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে এক নতুন যুগের দিক প্রদর্শক।
বাড়িতে চার দেওয়ালের মধ্যেই ছোটবেলার দিনগুলি কেটে গিয়েছিল মাইকেল ফ্যারাডের। স্কুলের পড়াশোনা কী তা বোঝার সুযোগ ছিল না। যে বয়সে ছেলেরা মন দিয়ে পড়াশোনা করে এবং অবসর সময়ে চুটিয়ে গল্পগুজব করে, সেই বয়সে বেচারি মাইকেল ফ্যারাডেকে কাজ নিতে হয়েছিল এক বইয়ের দোকানে। সারাদিন কাজ করতেন সেখানে। হাড়ভাঙা খাটনি। বইয়ের বান্ডিল মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হত। হিসেব নিকেশ করতে হত। পোকায় খাওয়া বইগুলোকে আলাদা করতে হত। শুধু তাই নয়, কাঁধে বই নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতে হত।
এমনকি অবসর সময়ে বই বাঁধাই করতে হত মাইকেল ফ্যারাডেকে।
এভাবেই বইয়ের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালোবাসার জন্ম হয়। মনের ব্যাপ্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এখানে তিনি পছন্দমতো বই পড়তে পারতেন। কখনো কখনো সারারাত ধরে বই পড়তেন। বিশেষ ভালোবাসতেন বিজ্ঞান ,তার সহজাত আকর্ষণ। বিশেষ করে বিজ্ঞানের বই পেলে তো আর কথাই নেই। কোথা থেকে সময় কেটে যেত, তা বুঝতেই পারতেন না।
কিন্তু প্রথাগত কোনো শিক্ষা ছিল না তাঁর। তাই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি উপলব্ধি করতে পারতেন না। পড়তে পড়তে কোথাও বাধা পেলে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হত মাইকেল ফ্যারাডের। ভাগ্যকে দোষারোপ করতেন তিনি। চোখ বন্ধ করে বসে থাকতেন। অংকের জটিল ফর্মুলা কিছুতেই বুঝতে পারতেন না। - কোথায় জ্ঞানের দেবী, আপনি আমার মধ্যে আসুন, আমার তৃতীয় চোখ খুলে দিন। আমি সবকিছু বুঝব। আমি এক বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হব। আকুল আহ্বানে তখন হয়তো একথাই বলতেন মাইকেল ফ্যারাডে।
তখন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা আসতেন বত্তৃতা দিতে। সাধারণ মানুষরা দলে দলে ভিড় করতেন সেই বত্তৃতা শুনবেন বলে। সময় এবং সুযোগ পেলে ফ্যারাডেও হাজির হতেন সেখানে।
সেখানে আসতেন হামফ্রে ডেভি। এক নামজাদা বিজ্ঞানী। ফ্যারাডে ভীষণ ভালোবসতেন ডেভির বত্তৃতা শুনতে। ডেভিকে দেখে তাঁর মনে হত, তিনি বোধহয় স্বর্গ থেকে খসে পড়া এক দেবদূত। যে করেই হোক, ডেভির বত্তৃতা শুনতে যেতেন মাইকেল ফ্যারাডে।
বত্তৃতার সব অংশ তিনি বুঝতে পারতেন না। তবু যতটা সম্ভব দুর্বোধ্য অংশগুলিও বোঝার চেষ্টা করতেন। বত্তৃতাগুলি কাগজে টুকে নিয়ে আসতেন। ঘরে এসে রাতের পর রাত জেগে চিন্তা করতেন। কখনওবা হাতেকলমে ছোটোখাটো পরীক্ষা করতেন। এইভাবেই ডেভির সঙ্গে তাঁর একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
অজানাকে জানার আগ্রহে একদিন দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলেন ফ্যারাডে। সরাসরি ডেভিকে একটি চিঠি লিখলেন তিনি। অশিক্ষিত ফ্যারাডের কাছ থেকে এই চিঠি পেয়ে ডেভি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ডেভি ভেবেছিলেন, লেখক বোধহয় সাধারণ একজন দপ্তরী। তবুও তিনি এই চিঠিটাকে অবজ্ঞা করেননি। নিজের কাজে খুবই ব্যস্ত থাকতে হত হামফ্রে ডেভিকে। তখন তিনি এক নামজাদা বিজ্ঞানী। তা সত্ত্বেও ফ্যারাডেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি।
আমরা জানি, ডেভি আর ফ্যারাডের সাক্ষাৎকার বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী, আর অন্যজন বইয়ের দোকানের স্বল্পশিক্ষিত কর্মচারী। দুজনের মধ্যে মনের মিল হবে কেমন করে? কিন্তু বিধাতার বোধহয় অন্যরকম অভিপ্রায় ছিল। তাই দেখা গেল, প্রথম সেই সাক্ষাৎকারেই ডেভি অবাক হয়ে গেছেন। ডেভি ভাবতে পারেননি যে, ফ্যারাডের মতো অর্ধশিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলিকে এইভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। সাক্ষাৎকারের শেষে তিনি আন্তরিকভাবে মাইকেল ফ্যারাডের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। তিনি, তাঁর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সদ্য তরুণ মাইকেল ফ্যারাডে সেদিন তাঁর স্বপ্ন সফল করেছিলেন।
ডেভি তাঁকে সহকারীর পদে গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মাইকেল ফ্যারাডের প্রতিভা যাতে অকালে ঝরে না যায়, তারজন্য সবরকম চেষ্টা করেছিলেন ডেভি। শুরু হল মাইকেল ফ্যারাডের নতুন জীবন। রসায়ন বিজ্ঞান নিয়ে ডেভির সঙ্গে গবেষণা করতে শুরু করলেন তিনি।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আলাদাভাবে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তখন অবশ্য তিনি এক প্রাজ্ঞ যুবকে পরিনত হয়েছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিরলস গবেষণার মধ্যে মগ্ন ছিলেন এই মহাবিজ্ঞানী। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান হয়। আজও মাইকেল ফ্যারাডে আমাদের কাছে এক জীবন্ত বিস্ময়। জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তির মহানায়ক - এসো, আমরা তাঁর উদ্দেশ্যে একটি সশ্রদ্ধ প্রনাম নিবেদন করি।

বইয়ের দোকানের কর্মচারী থেকে - পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী । মাইকেল ফ্যারাডের জীবনী বইয়ের দোকানের কর্মচারী থেকে - পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী । মাইকেল ফ্যারাডের জীবনী Reviewed by Wisdom Apps on সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.