চুল নিয়ে মানুষের ১২টি ভ্রান্ত ধারনা - পাকা চুল তুললে কি বেড়ে যায় ? ন্যাড়া করলে চুল ঘন হয় ?

 চুল তাে শুধু নারীর অহঙ্কার নয়, তার দুর্বলতাও। শুধু নারী কেন, পুরুষদেরও চুল নিয়ে আদিখ্যেতা কম নয়। এক মাথা চুল আজীবন মাথা ভরে থাকুক, শুধু থাকুক নয়, ঘন কালাে হয়ে থাকুক, এই প্রার্থনা মনে মনে সবারই। তাই আমাদের এই কেশরাশি নিয়ে নানা চেষ্টা, যার অধিকাংশই অপচেষ্টা।


ভুল ধারনা একঃ   বারবার ন্যাড়া করলে চুল ঘন হয় 

অনেক মায়েরাই ফি-বছর তাদের শিশুর মস্তক মুণ্ডন করিয়ে দেন, বিশেষ করে গরমকালে। এতে নাকি মাথা উর্বর হয়, চুলের গােড়া শক্ত হয়, ভালাে চুল গজায়, মাথায় গরম কম লাগে। বলা বাহুল্য সবকটি ধারণাই ভুল। চুল তাে আমাদের দেহত্বকেরই অংশবিশেষ। ছড়িয়ে থাকে প্রায় সারা দেহ জুড়েই। ত্বকের নীচে থাকে কেশকুপ বা হেয়ার ফলিকল এর মধ্যেই থাকে চুলের মূল বা রুট। চুলের কাণ্ড বা শ্যাফট থাকে কিউটিকল আর ভিতরে কর্টেক্স। হেয়ার ফলিকলের নীচে থাকে বাইরে, যেটি আমরা দেখতে পাই। মাথার চুলের দুটি আবরণ। বাইরে হেয়ার ম্যাট্রিক্স, যাতে থাকে নানা সজীব কোষ। এরাই চুলের বৃদ্ধি,পরিমাণ, রং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। চুলের পুষ্টি আসে ত্বকের পুষ্টি থেকে, যেহেতু চুল ত্বকেরই অংশ। কাজেই দেহের পুষ্টিই হল চুলের পুষ্টি। বারেবারে মাথা ন্যাড়া করলে চুলের গােড়ায় অর্থাৎ কেশকুপ বা হেয়ার ফলিকলে ক্ষুরের চোট লেগে ক্ষতি হতে পারে। ফলে চুল আর আগের মতাে নাও হতে পারে। অকালে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। কাজেই বারে বারে মাথা কামালে ফল হতে পারে উল্টো, এ যেন শিৰ গড়তে বাঁদর। মাথায় চোট-আঘাত লাগলে মাথা ন্যাড়া করে সেলাই করতে প্রয়ােজন হতে পারে। নানা ধরনের চর্মরােগেও মাথা ন্যাড়া করে চিকিৎসার প্রয়ােজন হতে পারে। তাছাড়া, আন-স্টেরিলাইজড ক্ষুর বা ব্লেড থেকে এডস্-এর মতাে ভয়ঙ্কর সংক্রমণও হতে পারে। 


ভুল ধারনা দুইঃ  প্রােটিন-ভিটামিন যুক্ত শ্যাম্পু ভালাে

প্রথমেই জেনে নিই কী কী উপাদান থাকে শ্যাম্পুতে থাকে নানা ধরনের ডিটারজেন্ট, ফোমিং এজেন্ট, থিকেনার্স, ওপাসিফায়ার্স সফটনার, সিকোয়েসরি এজেন্ট, স্পেশাল কেয়ার প্রােডাক্টস,কলারিং এজেন্ট, প্রিজারভেটিভস এবং ফ্লেমিং এজেন্ট। অনেক কোম্পানি আবার প্রােটিন ও নানা ধরনের ভিটামিন মেশান শ্যাম্পুতে, কেউ আবার ভেষজ নির্যাসও মেশান। বলাই বাহুল্য চুলের পুষ্টিতে এদের কোনও ভূমিকা নেই। চুলের পুষ্টি আসে দেহের পুষ্টি থেকে। আর চুল তাে দেহত্বকেরই অংশ। এটাসেটা মেখে চুলে জেল্লা বাড়লেও, চুলের পুষ্টি বাড়ে না। শ্যাম্পুর এক এবং একমাত্র কাজ হল চুলকে পরিষ্কার রাখা, আর কিছু নয়। শ্যাম্পুতে ডিটারজেন্ট রূপে থাকে সােডিয়াম ডােডাসাইল সালফেট, ল্যারিল সালফেট-সহ পেট্রোলিয়াম থেকে সংশ্লেষিত  রাসায়নিক পদার্থ। অনেকের এগুলাে থেকে মাথার ত্বকে অ্যালার্জিও হতে পারে।


ভুল ধারনা তিনঃ শ্যাম্পুর চেয়ে রিঠে ভেজানাে জল ভালাে

ছােটবেলায় মা-ঠাকুমাকে দেখেছি গরমকালে রিঠে সেদ্ধ করে তার নির্যাসযুক্ত জলে মাথা ঘষতে। তখন শ্যাম্পুর এত জনপ্রিয়তা ছিল না। সময় পাল্টেছে। চটজলদির যুগ। পানের দোকানেও এখন শ্যাম্পুর পাউচ পাওয়া যায়। খােল আর জলে গুলে মাথায় ঢালে। বাজার থেকে রিঠে কেন, তাকে জলে ফোটাও এসব হ্যাপা এখন কারওই পােষায় না। দুটোর কাজই তাে চুল পরিষ্কার করা। শ্যাম্পুতে চুল আরও বেশি পরিষ্কার হয়। সময় লাগে কম, জ্বালানির খরচও নেই। তবে যাঁদের শ্যাম্পুর রাসায়নিক থেকে মাথার ত্বকে অ্যালার্জি হয়, তাঁরা রিঠা ব্যবহার করতেই পারেন।


ভুল ধারনা চারঃ ডগা ফাটলে চুল ছােট করে কাটা উচিত

ছােট করে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে তাে আর চুলের ডগা ফাটা বন্ধ হবে না। কারণটা খুঁজে বার করতে হবে। প্রয়ােজনে ত্বক বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হবে। অনেকের ধারণা বারে বারে চুলের নীচের অংশ কেটে ফেললে, চুলের বাড় ভালাে হয়। এটিও বাক্তে হচ্ছে। এতে চুলের শেপ দর্শনধারী হতে পারে, কিন্তু চুল বাড়ে না। ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন আমাদের চুল এমনিই বাড়ে ০.৫ মিলিমিটার করে। চল্লিশের ঘরে পা দেওয়ার পর এই বৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমতে থাকে।


ভুল ধারনা পাঁচঃ  পাকা চুল তুললে আরও চুল পেকে যায়

এটা কথার কথা, সত্যি কথা নয়। চুল পাকতে পারে নানা কারণেই। একটা বয়সের পর যেমন চুল পড়তে শুরু করে, তেমনি পাকতেও শুরু করে। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ব্যক্তিবিশেষে এগুলাে কারও আগে হয় অর্থাৎ কম বয়সে, কারও বেশি বয়সে। এর পেছনে বংশগত কারণ অর্থাৎ জেনেটিক ফ্যাক্টর, মানসিক দুশ্চিন্তা, পরিবেশ দূষণ, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ অনেক ফ্যাক্টরই রয়েছে। কিন্তু পেট গরম হলে বা লিভার খারাপ হলে কিন্তু চুল পাকেও না, পড়েও না। চল দু-চারটে পাকলে অনেকেই সন্না দিয়ে গােড়া থেকে তাকে সমূলে উৎপাটন করেন, বেশি পাকলে কলপ লাগাতে হয়। কিন্তু পাকা চুল তুললে তার আশপাশের চুল পেকে যায়, এটা ছেলে ভােলানাে গল্প ছাড়া কিছু নয়।


ভুল ধারনা ছয়ঃ জোরে আঁচড়ালে চুল ভালাে থাকে

চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালে চুলের গােড়ায় কেশকুপে রক্ত সঞ্চালন কিছুটা বাড়ে। কিন্তু বারে বারে এবং জোরে জ্বেরে করলে চুলের কাণ্ড স্ট্রোকস আ ডে’ চুলের পক্ষে কখনওই ভালো নয়। চিরুনি বা ব্রাশ। যাই ব্যবহার করুন না কেন, তার দাঁতগুলাে হবে মােটা, দাঁতগুলাের মধ্যে যেন ফাঁক থাকে। স্টিলের দাঁতওয়াল চিরুনি কখনও ব্যবহার করবেন না। বারে বারে উল্টে চুল আঁচড়ালে ব্যাক ব্রাশিং বা কুম্বিং) চুলের ক্ষতি হয়। নিজের চিরুনি সব সময় আলাদা রাখুন, অন্যেরটা ব্যবহার করবেন না, চিরুনি নিয়মিত পরিষ্কার রাখবেন। 


ভুল ধারনা সাতঃ খুশকি থেকে চুল পড়ে যায়। 

সরাসরি খুশকির কারণে কারও চুল পড়ে না। পড়ে খুশকি থেকে চুলের গােড়ায় বা মাথার ত্বকে সংক্রমণ হলে। খুশকি কোনও রােগ বা রােগের লক্ষণ নয়। আমাদের ত্বকের একেবারে ওপরের করনিয়াল স্তর বা হরনি স্তরের মৃত কোষগুলাে অনবরত ঝরে যায়। আবার নতুন কোষ তৈরি শুরু হয় ত্বকের এপিডারমিসের একেবারে নীচের বেসাল স্তর থেকে। এই নতুন কোষ একটু একটু করে ওপরের দিকে ওঠে এদের বলে প্ৰিকল স্তর, আরও ওপরে উঠলে বলে গ্রানুলার স্তর। একদম ওপরের যে করনিয়াল স্তর, তার মৃত কোষগুলাে। মানের সময়, গামছা বা তােয়ালে দিয়ে মাথা মােছার সময় আমাদের অজান্তে এমনি উঠে আসে। এটাই হল খুশকি বা পিটিরিয়াসিস ক্যাপিটিস। মাথার ঘাম বা তেলে ময়লা আটকে গেলে অনেক সময় । খুশকিও 'তাতে আটকে যায়, মাথা ছেড়ে বাইরে যেতে পারে না । এতে জীবাণু সংক্রমণ হলে দেখা দেয় সেবােরিক ডার্মাটাইটিস। এই রােগে চুল পড়তে পারে। শুধু খুশকির কারণে কারও চুল পড়ে না। অতিরিক্ত খুশকি তাড়াতে মাথায় তেল দেওয়া বন্ধ রাখুন, অ্যান্টি ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুলের গােড়া পরিষ্কার রাখুন সপ্তাহে অন্তত তিন দিন। প্রয়ােজনে স্কিন স্পেশালিস্টের পরামর্শ নিন।


ভুল ধারনা আটঃ রােজ শ্যাম্পু করলে চুলের ক্ষতি হয়।

সপ্তাহে ক’দিন শ্যাম্পু করবেন? এটা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের ওপর। পরিবেশের উপর। এর সঙ্গে চুলের ক্ষতির কোনও সম্পর্ক নেই। জীবিকার প্রয়ােজনে যাঁদের রোজই বাইরে ঘােরাঘুরি করতে হয়, তাঁদের রােজই শ্যাম্পু করার প্রয়ােজন হতে পারে, ছুটির দিন। তৈলাক্ত চুল, তাঁদের চুলে ময়লা আটকায় তাড়াতাড়ি, শ্যাম্পুও বাদ দিয়ে। অন্যদের সপ্তাহে দু-তিন দিনই যথেষ্ট। আবার যাঁদের করতে হয় বারবার। আবার দূষণমুক্ত পরিবেশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সপ্তাহে একদিন শ্যাম্পু করলেই চলে। 


ভুল ধারনা নয়ঃ ব্লোয়ার দিয়ে চুল শুকনাে ভালাে

এ নিয়ে মহিলাদের ভীষণ বিব্রত হতে হয়। ভেজা চুলে মাথা ধরে, আচড়াতে অসুবিধা হয়, কারও বা চুলে জট হয়। এজন্য শুকনাে গামছা বা তােয়ালে দিয়ে বারে বারে চুল মুছে খােলা হাওয়ায় শুকিয়ে নেবেন। তাড়া থাকলে তবে ব্লোয়ার ব্যবহার করবেন। ব্লোয়ারের গরম হাওয়া যেমন দ্রুত চুল শুকিয়ে দেয়, তেমনি বেশি ব্যবহারে চুলের ক্ষতি করে। মাথার চুলের অন্তত ৬ ইঞ্চি দূরে ব্লোয়ার রাখবেন। এছাড়াও বেশি রােলার ব্যবহার করলে, খুব টাইট করে চুল বধিলে, টাইট রবার ব্যান্ড এবং ক্যাপ ব্যবহার করলেও চুলের ক্ষতি হয়। সােজা চুলকে কোঁকড়ানাে করবার জন্য অনেকেই পার্লারে যান পার্মিং করাতে ,বেশি পার্মিং কিন্তু চুলের ক্ষতি করে। 


ভুল ধারনা দশঃ পেঁয়াজ, ডিম, লেবু লাগানাে ভালাে

এগুলাের সঙ্গে চুলের ভালাে-মন্দের কোনও সম্পর্ক নেই। আগেই বলেছি চুল আমাদের দেহত্বকেরই অংশবিশেষ, দেহত্বকের মরা কোষ! এটা-সেটা মেখে তার ভালাে-মন্দ কিছুই হয় না। বরং ডিম-লেবু খেলে শরীরে পুষ্টি মেলে, সেই পুষ্টি চুলও পায়। ডিমে থাকে প্রথম শ্রেণীর প্রােটিন ও দেহের জন্য প্রয়ােজনীয় সবকটি অ্যামাইনাে অ্যাসিড, লেবুতে থাকে প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। 


ভুল ধারনা এগারোঃ তেলে চুল তাজা! 

এটি প্রচলিত একটি কথা। তবে পুরােপুরি সত্যি নয়। শুধু তেল কেন, আলাদা করে কোনও কিছু মেখেই চুলের পুষ্টি বাড়ে না, চুল পড়া ও চুল পাকা। বন্ধ হয় না। তবে তেল মাখতে গিয়ে চুলের গােড়ায় যে মাসাজ হয় সেটা অবশ্যই উপকারী। এতে চুলের গােড়ায় রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। তেলের বদলে ক্রিম দিয়েও এই কাজটি করা যেতে পারে। তবে যাদের চুল রুক্ষ তারা সপ্তাহে দু-তিনদিন অল্প তেল বা ক্রিম লাগাতেই পারেন। বেশি তেল দিলে চুলে বেশি করে ময়লা আটকাবে, কেশকূপ বন্ধ হয়ে বিপত্তি ঘটাবে। মাথার ত্বকের সিবেসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত তৈলাক্ত ‘সিবাম’ চুলকে তেলতেলে রাখে। 


ভুল ধারনা বারোঃ বার বার শেভ করলে চুল গজায়

অনেকে এটা বিশ্বাস করেন, 'তাই বারে বারে শেভ করেন কম চুলের জায়গায়। বলাবাহুল্য এই ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। শেভ করলে চুলের কাণ্ড, যা কিনা একটি মৃত প্রােটিনের সুতাে মাত্র, সেটাই কাটা পড়ে। চুলের গােড়া বা হেয়ার ফলিকলের কোনও পরিবর্তন হয় না । কাজেই এটিকেও ভ্রান্ত ধারনা বলা চলে ।

চুল নিয়ে মানুষের ১২টি ভ্রান্ত ধারনা - পাকা চুল তুললে কি বেড়ে যায় ? ন্যাড়া করলে চুল ঘন হয় ? চুল নিয়ে মানুষের ১২টি ভ্রান্ত ধারনা - পাকা চুল তুললে কি বেড়ে যায় ? ন্যাড়া করলে চুল ঘন হয় ? Reviewed by Wisdom Apps on আগস্ট ০৩, ২০২১ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.