হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করুন
সাবধান বা সতর্কবার্তার প্রশ্ন নয়। শর্তটা জরুরি জীবনযাত্রা অনুসরণের। আর সেটা শুরু করতে পারলে শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়, প্রতিরোধ করা যাবে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এমনকি দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো ব্যাধি।
আসলে সমস্যাটা গোড়াটা লুকিয়ে আছে আমাদের মনে। আমরা ভাবি সুস্থ জীবন যাপনের অর্থ ভোগবাসনা ত্যাগ করা। এই ভয়েই সঠিক জীবনপ্রণালি আসলে কেমন হওয়া দরকার তার হদিশ খোঁজার চেষ্টায় করিনা।
এই আলোচনায় সেই চেষ্টায় একবার নতুন করে হয়ে যাক।
আর্নল্ড শোয়াৎজেনেগার আর কুকিজ: শুরুটা করা ভাল, শুরু থেকেই। একটি শিশু ৬ মাস বয়সের পর থেকে ধীরে ধীরে শক্ত খাবার খেতে শুরু করে। তখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে অভিভাবকদের ঘরে বানানো খাবার দেওয়ার। কৌটো বন্দি খাবার যতটা সম্ভব না দেওয়ায় ভালো। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি আর্নল্ড শোয়াৎজেনেগার আমেরিকার একটি শহরের মেয়র ছিলেন। তিনি একসময় ছোটদের জন্য তৈরি কুকিজ বিস্কিটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কুকিজ স্বাদে অতুলনীয় হলেও এতে 'ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড' বা খারাপ ফ্যাট থাকে প্রচুর পরিমানে। এই ধরণের খাদ্যে 'ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড' দেওয়া হয় খাবারের পচন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে। তাই ছোট বেলা থেকে কুকিজ খেলে হার্টের আর্টারি ব্লক হতে শুরু করে। প্যাকেটজাত খাবারেও থাকে ট্রান্স ফ্যাট। তাই ছোট হন বা বড়, যতটা সম্ভব প্যাকেটজাত, প্রিজারভেটিভ দেওয়া খাবার খাওয়া কমাতে হবে সবাইকেই। জোর দিতে হবে আমাদের প্রথাগত খাদ্যের ওপর। ভাত, রুটি, ডালের সঙ্গে বেশি পরিমাণে টাটকা সবজি, মাছ রাখুন ডায়েটে। ঋতু অনুযায়ী দিনে অন্তত দুটো ফল খান। এবং অতি অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে জলপানের অভ্যাস করুন। এই সুঅভ্যাস নিজেও যেমন করবেন, তেমনই সন্তানের ছোট বয়স থেকেই গড়ে তুলবেন। আর শিশু মুখরোচক খাবার খেতে বায়না করলে, মাঝে মধ্যে ঘরে বানানো টাটকা মুখরোচক খাবার স্বল্প পরিমানে দেওয়া যেতে পারে। আর শুধু শিশু নয় অভিভাবকরাও ভালো খাবার খাওয়া অভ্যাস করুন। কারণ আপনি নিজে অতিরিক্ত তেল মশলা দিয়ে খাবার খেতে শুরু করলে, বাড়ির বাচ্চাটিও একই খাবার খেতে চাইবে। মনে রাখবেন, আপনি নিজে যেমন জীবনযাপন করবেন, আপনার সন্তানও সেই ধরণের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবে।
আর বাচ্চাকে প্রথম থেকেই উৎসাহিত করতে হবে খেলাধুলা, শরীরচর্চায়। তাকে কার্টুন চ্যানেল দেখতে অভ্যস্ত করলে সে হয়ে উঠবে ঘরকুনো স্বভাবের। শরীরে অকালেই ফ্যাট জমতে শুরু করবে। মনে রাখবেন ছোট বয়স থেকে খেলাধুলা করলে শরীরের গঠন ভালো হয়, পেশী সবল। ফলে সে সুস্থ সবল হয়ে কৈশোরে পা রেখে। বাইরের খাবার বিশেষত ফাস্টফুড থেকে যতটা সম্ভব তাকে সরিয়ে রাখতে হবে। আর যে সব বাড়িতে হৃদরোগের প্রকোপ আছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি করা প্রয়োজন। বাচ্চার পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে তা চিন্তার বিষয়। শিশুটির ঠাকুমা, ঠাকুরদা বা অন্যকোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যেমন কাকা, মামা এদের মধ্যেও যদি হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ এর সমস্যা বা ব্লাড সুগার হওয়ার ইতিহাস থেকে তাহলে প্রথম থেকেই সাবধান হওয়া ভালো।
বয়ঃসন্ধির ইচ্ছে: এর পর বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এই সময় তাদের মানসিক গঠনের সাথে সাথে শারীরিক গঠনের দিকেও নজর দিতে উৎসাহিত করুন। তাকে নিয়ে সকালে জগিং এ বেরিয়ে পড়ুন। বাড়িতে নিজে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে পারেন। আপনাকে ফিট দেখলে বাচ্চার মনেও শারীরিক ভাবে সুস্থ হওয়ার ইচ্ছা জাগবেই।
টিনএজাররা পড়াশোনার কারণে দীর্ঘসময় বাইরে থাকে। টিউশনের ফাঁকে বাড়ি ফেরার সময় থাকে না। খিদে পেলেই রোল চাউমিনে ঝুঁকে পড়ে মন। তাই ওদের পড়ার ব্যাগে পুরে দিন টিফিন বাক্স। সেখানে থাকুক হাতে গড়া রুটি আর সবজি। তবে মাঝে মধ্যে একদিন চাইনিজ খেয়ে মুখের স্বাদ বদল করলে বকাঝকা করবেন না যেন।
চিন্তার ব্যাপার হলো বয়ঃসন্ধিতে অনেকের মধ্যে ধূমপানের অভ্যেস চলে আসে। প্রথমে খেলার ছলে করলেও পরে বদঅভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। সে ব্যাপারে মা, বাবা বা বাড়ির অন্যান্য পরিজনরা শান্তভাবে সন্তানকে বোঝান ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে। আর বাড়ির কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ধূমপান করলে, সেখান থেকেও কিশোররা দেখে শেখে ধূমপান করা। তাই অভিভাবকরা নিজের সন্তানের স্বার্থে ছেড়েদিন ধূমপানের অভ্যেস।
আর যে সমস্ত পরিবারের সুগার, অতিরিক্ত কোলেস্টেরলে ভোগার ইতিহাস আছে তাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। এইসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা কৈশোরে পড়া মাত্রই সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যৌবনের উপলব্ধি: এরপর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রবেশ করলে ছেলেমেয়েরা অনেকটাই অভিভাবকদের নাগালের বাইরে চলে যায়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বা কর্মের তাগিদে থাকতে হয় বাড়ির বাইরে। তাই ছোটথেকে সুঅভ্যাস গড়ে না তুললে পরবর্তী জীবন হয় লাগামহীন। অন্যদিকে যারা এখন বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাদের বেশিক্ষণ একই জায়গায় বসে কাজ করতে হয়। ফলে এদের মধ্যে লাইফস্টাইল ডিজিজ এর প্রবণতা বাড়ে। শরীরের মধ্যদেশ স্ফীত হয়। একটানা বসে কাজ করার ফলে কোমর ও মেরুদণ্ডের ওপর চাপ বাড়ে। আর হাঁটাচলা ও ঘুম কম হওয়ার ফলে ধীরে ধীরে ওজন বৃদ্ধি পায় এবং ওজন বৃদ্ধি হওয়ার ফলে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ে। এগুলোই হাত ধরে ডেকে আনে হৃদরোগ।
আবারও বলি ছোট বাচ্চাদের মধ্যে সুঅভ্যাস গড়ে তুলুন। বেশি করে টাটকা শাকসবজি, ফলমূল, সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় রাখুন। আর যেসব পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে তারা শুরু থেকেই রেডিমেট খাওয়া একেবারে বন্ধ করে ফেলুন।
অনেকে বলেন ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের আওতার বাইরে চলে গেলেই গন্ডগোল শুরু হয়।
অনেক রাত অবধি জাগা, লেট নাইট পার্টি করা, সিগারেট, অ্যালকোহল আসক্তির কুঅভ্যাস তৈরি হয়। সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠে ব্রেকফাস্টের বালাই থাকে না। একেবারে মধ্যাহ্নভোজ ফলে ওজন বাড়ে। সকালে কিন্তু ৯টার মধ্যে ভারী ব্রেকফাস্টের দরকার। তার পর সারাদিনে অল্প অল্প করে খাওয়া যেতে পারে আর রাত্রি ১০টার মধ্যে খেয়ে নিয়ে পরে কিছুক্ষন জেগে কাজ করা যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের রাত জেগে কাজ করতে হয় মাঝে মধ্যেই, তারা রুটিনে সামান্য হেরফের করে যতটা সম্ভব নিয়ম মেনে চলুন। এভাবেই দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা সম্ভব।
ছোট্ট কিছু টিপস:
সমস্যাটা শুরু হয় বাড়ির হেঁসেলে। সেখানে খাবার সুস্বাদু করতে অতিরিক্ত তেল, ঘি, মশলা, নুন ব্যবহার করা হয়। চিকেন কষায় তেল না ভাসলে অনেকের মুখে রোচে না। অনেকেই তো চিকেন বলতে শুধু কাবাব বোঝেন! বহু লোক তো পাতে একটুকরো রেডমিট না পড়লে ভাতে হাত ছোয়ান না। তারপর বাজার থেকে তেলভরা মাছ না কিনলে প্রেস্টিজ জলে ভেসে যায়। আবার অনেকের অভ্যাস একমুঠো কাঁচা নুন নিয়ে খেতে বসা। রাতে খাওয়ার পর দুটো মিষ্টি না খেলে অনেকের মন-পেট দুটোই খালি থেকে যায়। এদের জন্য পরামর্শ - মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না বাঁচার জন্য খায়। আর সেই খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ভাত, ডাল, রুটি, ছোট মাছ, মুড়ি, খই, শাকসবজি, সস্তার ফল দিয়ে অনায়াসে পূরণ করা যায়। এতে শরীর যথেষ্ট কর্মক্ষম থাকে। সুস্থ শরীরে দীর্ঘদিন কাজ করার ক্ষমতা বজায় থাকে। অকালে অথর্ব হয়ে জীবন কাটাতে হয় না।
অনেকেই ভাবেন ওষুধ খাচ্ছি তো, অত ধরাবাঁধা জীবনে থাকার দরকারটা কী? তাদের বুঝতে হবে, ওষুধ শুধু হার্টের রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একবার খারাপ হয়ে গেলে হার্টকে আগের মতো টগবগ করে তুলতে পারে না কোনো মতেই। তাই হার্টকে সুস্থ রাখতে হলে জিভ, হেঁসেল ও জীবনযাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আনা ছাড়া কোনো পথ নেই।
এগুলির সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় পর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও জরুরি। বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ, ব্লাড সুগার হওয়ার পারিবারিক ইতিহাস আছে এবং যারা ধূমপানে অভ্যস্ত তাদের ক্ষেত্রে ৩৫ বছর পেরোনোর পর থেকে কিছু রুটিন পরীক্ষা যেমন- ১) ব্লাড সুগার ২) ইসিজি ৩) রক্তচাপ ৪) রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বছরে একবার অন্তত মেপে নেওয়া দরকার। প্রয়োজনে টিএমটি করাতে পারেন। কোনো রকম গরমিল ধরা পড়লেই উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার। এগুলির আসল উদ্দেশ্যই হলো হার্টের অসুখটিকে যতটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। যাতে আমরা সুস্থ সবল কর্মক্ষম জীবন কাটাতে পারি।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে এখনই পড়ুন
Reviewed by Wisdom Apps
on
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৮
Rating:
![হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে এখনই পড়ুন](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjXp1CbimjR3bAKRG7FkvvIgLp9QWQu34qSrHkIyTq9vq5KQQwdG02GHDiJuBjPstrx7tga8hjnk0iRwp5tpzY9I0uLetwp5jLqSUlJYCkzX6v6bjOSePg-8HeqDU7tLEGL-rMVfIPjkNil/s72-c/xcx.jpg)
কোন মন্তব্য নেই: