কালিম্পং ও লাভায় কি দেখবেন , কীভাবে যাবেন

কালিম্পং

ছোট শৈলশহর কালিম্পং। মনোরম আবহাওয়া এই অঞ্চলের প্রশস্তির কারণ। বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশের ঘিঞ্জি অঞ্চল বাদ দিলে, এখানকার পাহাড়,  অরণ্য, দূষণহীন প্রকৃতি, সহজ সরল মানুষ, ছোটো ছোটো ক্ষেত, আর মেঘমুক্ত দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভেসে ওঠা তুসারচ্ছাদিত শৃঙ্গ---সব মিলিয়ে কালিম্পং অনন্য। রবীন্দ্রনাথের গৌরীপুর হাউস, গ্রাহাম সাহেবের গড়া মিশনারি আশ্রম, ক্যাকটাস-অর্কিড ফার্ম, চার্চ, গুম্ফা নিয়ে পূর্ব হিমালয়ের এই শহর প্রকৃতির অজস্র দানে সমৃদ্ধ এই কালিম্পং। এখানে শীত তেমন প্রবল নয়। দুর্গাপুজোর সময় কালিম্পং গেলে দেখা যায় গোর্খাদের দশই উৎসব। মহালয়ার দিন শুরু হয়ে চলে পূর্ণিমা পর্যন্ত। শক্তির প্রতীক হিসাবে কুকরির পূজা হয়। 
অতীতে এই অঞ্চল ছিল ভুটানে। কালিম অর্থাৎ রাজমন্ত্রী এবং পং বা শক্ত ঘাঁটি থেকেই নামকরণ কালিম্পং, যা ১৮৬৫ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় ভারতের এবং ১৯১৬ সালে সাব ডিভিশনের মর্যাদা পায়। ১৯৫০-এ চীনের তিব্বত অধিগ্রহণ পর্যন্ত এই শহর ছিল উল ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র।
এই অঞ্চলের শ্বেতপাথরের মঙ্গলধামে রাধাকৃষ্ণের মন্দির পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে ভাল লাগে। শহর থেকে ৭ কিমি দূরে ৫৫০০ ফুট উচ্চতায় দেলো ভিউ পয়েন্ট, যা কালিম্পং এর সর্বোচ্চ স্থান। এখান থেকে কানিম্পং শহর ছাড়াও দেখা যায় দুরের বহমান তিস্তা। আবহাওয়া ভাল থাকলে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। পথের ধারে অজস্র অর্কিড আর ফুল যার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। কাছেই কালিম্পং-এর পর্যটনের নবতম সংযোজন সাইন্স সিটি। ছোটদের খেলার সাথে বিজ্ঞানভিত্তিক শো, সঙ্গে ছোট্ট জুরাসিক পার্ক। দেলো থেকে ফেরার পথে চোখে পড়বে গ্রাহাম সাহেবের ভূমিকা অবিসংবাদিত।
কালিম্পঙয়ের গ্রাম, তিস্তা নদী, রেলি নদীকে উপর থেকে দেখা যায় জেলেপলা ভিউপয়েন্ট থেকে। এখানকার জং দং পারলি গুম্ফা, না দেখে ফেরা উচিত নয়। গুহার বাইরে রঙিন কারুকার্য। ভিতরে আধো আলোছায়ায় গুরু পদ্মসম্ভবা আরও অনেকের মূর্তি। এখানকার দেওয়াল চিত্রগুলি অসাধারণ। রয়েছে নানান দুস্প্রাপ্য পুঁথি। গুম্ফায় শিশু লামাদের জীবনচর্চা প্রত্যক্ষ করা যায়। আর দোতলার বারান্দায় উঠলে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম দৃশ্য। এছাড়াও কালীমন্দির, ক্যাকটাস-অর্কিডের পাইনভিউ নার্সারিও দর্শনীয়। শহরের দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে থার্পা চোলি গুম্ফা, কালিম্পং বঙ্কিম পার্ক, দুরপিন গুম্ফা, দুরপিন ভিউপয়েন্ট, গৌরীপুর হাউসের মতো দ্রষ্টব্যস্থানগুলি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে দেখে নেওয়া যায়। দমকার চকে পর্যটন দপ্তর থেকে এই সব ট্যুর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও বুকিং করা যায়। 
বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই দার্জিলিং জেলায় ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে হোম স্টে ট্যুরিজম। তথাকথিত উন্নত তথা প্রথিতযশা ভ্রমনকেন্দ্রের ভিড় এড়িয়ে তারাই অদুরে ছোট্ট গ্রামের একটি বা দুটি বাড়িতে স্থানীয় মানুষ তাদের বাড়ির অব্যবহৃত কয়েকটি ঘরে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। সঙ্গে সুযোগ রয়েছে তাঁদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে অতি নিকট আত্মীয়তার সুযোগ। কালিম্পং থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে এমনই এক গ্রাম,ছিরো। দুরপিন ভিউপয়েন্টের কাছেই এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটা ক্যাকটাস গার্ডেন। দূষণমুক্ত পরিবেশে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা এই গ্রাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য অনন্য সুন্দর। সঙ্গে অতিরিক্ত পাওনা, জানা অজানা বিভিন্ন পাখির কলতান।
কালিম্পং থেকে ৯ কিমি দুরত্বে রেলি নদীতীরে রেলিখোলা। একদিকে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদীর জলধারা, অন্যদিকে তাকালেই শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রকৃতির নীরবতা ভঙ্গ করা পাখির কলতান মনকে ছুঁয়ে যায়।
কালিম্পং থেকে রংপোর পথে ১৪ কিমি দুরত্বে সাংসের। শান্ত, মনোরম এই গ্রামের খ্যাতি সিঙ্কোনা চাষের জন্য। রয়েছে শতবর্ষ প্রাচীন বাংলো, এখান থেকে দৃশ্যমান তিস্তার ধারা কাঞ্চনজঙ্ঘা। পায়ে হেঁটে গ্রামের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে দেখা মেলে বিভিন্ন পাখির।
কালিম্পং-এর ভিড় এড়িয়ে রেলির পথে মাত্র ৫ কিমি দুরত্বে পুড়ুং। স্থানীয় এক গ্রামবাসী তাঁর পুরনো বাড়িটির দোতলায় দুটি ঘরে রাত্রিবাসের ব্যাবস্থা রেখেছেন  উৎসাহী পর্যটকদের জন্য। শান্ত-স্নিগ্ধ-নির্মল প্রকৃতির মাঝে থাকার ফাঁকে বেরিয়ে পরা যায় গ্রামের আঁকা-বাঁকা পথের চড়াই-উৎরাই সামলে তথাকথিত 'ভিলেজ ওয়াক'-এ। 
কালিম্পং থেকে ১৪ কিমি দুরত্বে পর্যটনের নুতন ঠিকানা রামধুরা। সবুজে মোড়া মেঘের রাজ্য। সিঙ্কোনা চাষের জন্য খ্যাত এই পাহাড়ি গ্রাম অনেকের কাছে বার্মিক নমেও খ্যাত। এখান থেকে একই সাথে দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তিস্তা ভ্যালি। এমনকি পরিস্কার রাতে দৃশ্যমান দুরের দার্জিলিং শহরের আলোকমালা। রামধুরার অন্যতম আকর্ষণ জলসা বাংলো, যা তৈরি হয়েছিল ১৯৩০ সালে। কালিম্পং থেকে আসার পথে রয়েছে হনুমানটক ভিউ পয়েন্ট। উৎসাহীরা দেখে নিতে পারে মাধবধাম মন্দির। 
রামধুরা থেকে ২ কিমি দুরত্বে ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় ইচ্ছেগাও। হোম স্টে কেন্দ্রীক এই অপরিচিত ভ্রমনকেন্দ্র থেকে মাত্র ঘণ্টা খানেকের ট্রেকপথে পৌঁছানো যায় সিলেরিগাও/ ঘন জঙ্গলের পথের দেখা মেলে বিভিন্ন রঙের মকড়সার। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও দেখা মেলে পূর্ব হিমালয়ের বেশ কয়েকটি বরফে মোড়া শৃঙ্গ।

কীভাবে যাবেনঃঃ শিলিগুড়ি থেকে ৭০ কিমি ও বাগডোগরা থেকে ৮০ কিমি দুরত্বে কালিম্পং। তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর বাস ছাড়ছে কালিম্পঙের। শিলিগুড়ির পানিট্যাঙ্কি জিপ স্ট্যান্ড থেকে কালিম্পঙের জিপ পাওয়া যায়। সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। দার্জিলিং থেকেও চলেছে শাটেল জিপ/গাড়ি। কালিম্পং থেকে গ্যাংটক যাওয়ার বাসও পাওয়া যায়। জিপ চলেছে আধ থেকে এক ঘণ্টা অন্তর। সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। এছাড়াও লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ-পেডং-হৃষি-নেওড়া ভ্যালি জঙ্গল ভ্রমনের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার এই কালিম্পং। 


 লাভা 

কালিম্পং থেকে ৩২ কিমি দূরের ২১৮৪ মিটার উচ্চতায় পাইন-ফারের জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শান্ত পাহাড়ি জনপদ লাভা। লাভা শব্দের অর্থ ঈশ্বরের বাসভূমি। কালিম্পং থেকে  আলগারা পেরিয়ে পথেই অনুভূত হবে নামকরণের যথার্থতা। একসময় দার্জিলিং জেলার পর্যটন মানচিত্রে থাকত দার্জিলিং-কালিম্পং-কার্শিয়াং, সঙ্গে সান্দাকুফু ও মিরিক। এই মানচিত্রে কালিম্পং-এর সীমানা ছড়িয়ে একে একে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ভ্রমনকেন্দ্র। ভৌগলিক অবস্থানের জন্য সেই তালিকায় প্রথমেই চলে আসে লাভার নাম। কারণ এই লাভা-কে কেন্দ্র করে একে একে ঘুরে নেওয়া যায় লোলেগাঁও-রিশপ-নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান-চারখোলা-চুইমাখি এমনকি ঋষি-পেডং-ও। পর্যটনের প্রসারের ফলে যথেষ্ট জনবহুল হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল, পড়েছে শহুরে ছাপ। এখান থেকে দেখা মেলে বেশ কয়েকটি গিরিশৃঙ্গ, যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, কোকতাং, পান্ডিম, সিনিয়লচু ইত্যাদি। লাভা থেকে ৩ কিমি দূরে টিফিনদাড়া ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় অসাধারণ। এখান থেকে রিশপ গিয়ে চরুইভাতি আয়োজন করা যায়। তবে বিকেলের মধ্যে লাভায় ফিরে আসা উচিত। সময় থাকলে পায়েহেটে ঘুরে নিতে পারেন নেওড়া ভ্যালি। 

কাছেই টিলার মাথায় বৌদ্ধদেব গুম্ফা। ভোরবেলায় ভেসে আদে লামাদের প্রার্থনা সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্রের গুরুগম্ভীর সুর। গুম্ফা প্রাঙ্গন থেকে দৃশ্যমান হয় পাহাড়ের ঢালে লাভা গ্রাম। পাহাড়ের উপর ঘন সবুজ পাইনের বন। লাভা ভ্রমনের সবচেয়ে ভালো সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। বর্ষায় এখানে খুব জোঁকের উৎপাত হয়। মার্চ-এপ্রিলে লাভার প্রান্তর ফুলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। মনে হয় ঈশ্বর যেন তার সব রঙ দিয়ে এখানে হোলি খেলেছেন।

লাভা থেকে মাত্র ৪ কিমি দুরত্বে সানফুং, অনেকে বলে লোয়ার রিশপ। একদিকে হিমালয়ের শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গরাজি, অন্যদিকে রডোডেনডরেনের বাহার। পক্ষীপ্রেমীদের কাছেও আকর্ষণীয় এই গ্রাম। সুযোগ রয়েছে ঘণ্টাখানেকের ট্র্যাকপথে সানফুং জলপ্রপাত দেখে আসার।

লাভা থেকে মাত্র ১৪ কিমি দুরত্বে ৬২০০ ফুট উচ্চতায় ঝান্ডি, দার্জিলিং জেলার নবতম পর্যটনকেন্দ্র। লাভা থেকে গরুবাথানের পথে এগিয়ে আলাদা পথ চলেছে ঝান্ডি পাহাড়ের প্রাচীন জনপদ আপার লুংসেল-এ। দূষণহীন পরিবেশে, সবুজে মোড়া এই জনপদ থেকে মেঘমুক্ত দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য। এখান থেকে দৃশ্যমান ডুয়ার্স ও তরাই। শিলিগুড়ি থেকে ডামডিম-গরুবাথান হয়ে দুরত্ব ৮৭ কিমি। আবার নিয় মাল জং থেকে চা বাগানের মধ্য দিয়ে পথ এসেছে ঝান্ডি, দুরত্ব ৩২ কিমি।তাই ডুয়ার্স ঘুরে সরাসরি দার্জিলিং-এর পাহাড়ে পৌঁছনোর মাঝে একরাত কাটানো যেতে পারে এই লুংসেল গ্রামে। 

কীভাবে যাবেনঃ কালিম্পং থেকে আলগারা হয়ে ৩৩ কিমি দুরত্বে লাভা। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং হয়ে লাভার দুরত্ব ৯৯ কিমি, সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। তবে শিলিগুড়ি থেকে লাভা আসা যায় ওদালবাড়ি-ডমডিম-গরুবাথান হয়েও। তরাইয়ের পথে সময় একটু কম লাগে, সঙ্গে মেলে নতুন জায়গা দেখার অভিজ্ঞতাও। শিলিগুড়ি ও কালিম্পং থেকে বাস চলছে, লাভা। ফেরার বাস মেলে সকালের দিকে। শেয়ার জিপ মেলে কম,তাই উচিত হবে জিপ ভাড়া করে চলা। 

কালিম্পং ও লাভায় কি দেখবেন , কীভাবে যাবেন কালিম্পং ও লাভায় কি দেখবেন , কীভাবে যাবেন Reviewed by Wisdom Apps on অক্টোবর ০৫, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.