বনফুল ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু বাণী

বলাইচাদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলের কিছু কথা - 


• অসমাপ্ত জিনিসের না বলা বাণী আছে একটা। তা অব্যক্তরূপেই বিকশিত • ‎পরের মেয়েকে গৃহিণী করার প্রথা শুধু যে প্রজনন বিজ্ঞানের উপযোগীতার জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল তা মনে করবার কোনো কারণ নেই। প্রজনন বিজ্ঞান পরের ব্যাপার। রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম জমে না - এই সত্যটাই মানুষ বোধহয় অনেক আগে আবিষ্কার করেছিল। • ‎ক্ষুধাকে অনুসরণ করে চলতে থাক, ঠিক পথে পৌঁছে যাবেই একদিন না একদিন। ক্ষুধাটা যদি সত্যি হয় তবে তার আগুনে অখাদ্যও হজম হয়ে যাবে। • ‎কাব্যই কবির জীবন, কাব্যই তার স্ফূর্তি, কাব্যলোকই তার কাছে একমাত্র আনন্দলোক। কিন্তু কাব্যের আনন্দরূপ কবি মোনে মূর্ত হয় না সব সময়ে, সরসী থাকলেই যেমন কমল ফোটে না। উনপঞ্চাশ বায়ু-বাহিত অপরূপ উপলক্ষ এসে হাজির হয় অকস্মাৎ কোনো অজানা আকাশ থেকে। শিহরণ জাগে, পাখি ডাকে, সাড়া পড়ে যায় কিশলয়দের নিদমহলে, বাঁশি বেজে ওঠে বনে বনে। • ‎সকলেই আনন্দ চায়, নানাভাবে সবাই সেটা পেতে চাইছি। সাধারণ লোকের বাইরে জীবনটাকে যদি বাঁশি বলি তাহলে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতিকে সেই বাঁশির ছিদ্র বলা যেতে পারে। অধিকাংশ লোকই আনন্দ পাওয়ার আশাতে নানা সুরে আলাপ করছে ওতে।  • ‎আমাদের স্বাধীন ভারতের সাহিত্য, সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ কি? যতটা দেখতে পাচ্ছি তাতে আশার আলোক কিছু নেই। আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ক্রমশ হারাচ্ছি, বিদেশাগত সংস্কৃতি ও আমাদের বাঁচাতে পারবে না কারণ সেই সংস্কৃতি ও নিঃস্ব। বিদেশের যে সংস্কৃতির আস্ফালন আমরা অহরহ শুনতে পায় তা পশুর গর্জন, সুসভ্য মানবতার সংগীত নয়। • ‎অনবদ্য সৌন্দর্যের পায়ে লীলাময়ী প্রকৃতির কাছে সম্পূর্ণ রূপে আত্মসমর্পণ করে কৃতার্থ হয় যে, সেই কবি, সেই শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, সৃষ্টি রহস্যের সারমর্ম সেই বুঝেছে। • ‎পাখিরা যত আধুনিক হচ্ছে তত যেন তারা মানুষের মনোহরণ করে মানুষের বন্ধুত্ব কামনা করছে। মানুষের মধ্যেও যেমন বিশ্বমৈত্রীর ভাব জাগছে ক্রমশ, মানুষ যেমন হিংসার পথ ত্যাগ করে প্রেমের পথ, আনন্দের পথ বেছে নিচ্ছে, আনন্দ দিচ্ছে, আনন্দ পাচ্ছে, পাখিদের মধ্যেও সেরকম কিছু একটা হচ্ছে হয়তো। তা না হলে এত বর্ন বৈচিত্রের কোনো মনে হয় না যেন। • ‎মোহটা হচ্ছে তাকে চেনাবার কষ্টিপাথর। কষ্টিপাথর সোনা নয়। কিন্তু সোনার পরিচয় ওর থেকেই পাওয়া যায়। যেকোনো জিনিসেই আমরা মুগ্ধ হয় না কেন, কিছুদিন পরেই তার নেশাটা কেটে যায়। কারণ মোহ নকল আলো, আসলে ওটা অন্ধকারই। ওই মোহই আমাদের জানিয়ে দেয় আমরা ভুলপথে গেছি। মন বলে ওঠে হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনো খানে। • ‎চরাচরে সমস্তকিছু বাঁচতে চাইছে, উপভোগ করতে চাইছে নিজের অস্তিত্বকে নানাভাবে এবং তার জন্য না করছে এমন জিনিষ নেই। ভালো-মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল, সভ্য-অসভ্য সব কিছুই হচ্ছে সে জীবনকে সার্থক করার প্রেরণায়। • ‎সবাই নিজের নিজের আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়।


প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু কথা - 


•  প্রেম বস্তুটি হলো মূল্যহীন ফুলের বিনিসুতোর মালা। • ‎আমাদের কাজের কথায় যখন কোনো ফল ধরে না তখন বাজে কথার ফুলের চাষ করলে হানি কি? • ‎আমরা মুখে কি বলি তার চাইতে আমরা মনে কি ভাবি তার মূল্য আমাদের কাছে ঢের বেশি। কেননা সত্যের জ্ঞান না হলে মানুষ সত্য কথা বলতে পারে না। • ‎ভাষার বর্তমান অবস্থা এই যে, এক শব্দ শুধু একটি ভাবের প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকে না, কিন্তু তার সঙ্গে অস্পষ্ট মনোভাবকে জাগিয়ে তোলে। একটা উপমার সাহায্যে কথাটা পরিষ্কার করা যাক। সেতার, এসরাজ প্রভৃতি যন্ত্রে দেখা যায় যে, এমন অনেকগুলি তার আছে যেগুলোকে বাদক স্পর্শ করে না। এ তারগুলিকে যন্ত্রীরা তরফের তার বলে। যে তার বাদক স্পর্শ করে, সেই তারের ধ্বনি ঐ অদৃশ্য তরফের তারের বেতার বার্তা আনে বলেই স্পষ্ট তারের ধ্বনি তার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য লাভ করে। নিজ ভাষায় কাব্য আমাদের মনোবিনায় যে ঝঙ্কার তোলে, কোনো বিদেশির মনে সে ঝঙ্কার তুলবে না। কারণ আমাদের মনে সেই সব তরফের তার আছে, বিদেশীর মনে তা নেই। • ‎ভুল করেছি- এই জ্ঞান জন্মানো মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করিতে পারিলে ব্যবহারের অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ। • ‎অতি বিজ্ঞাপিত জিনিসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা খুব কম। কারণ, মানব হৃদয়ের স্বাভাবিক দুর্বলতার ওপর বিজ্ঞাপনের বল এবং মানবমনের সরল বিশ্বাসের উপর বিজ্ঞাপনের ছল প্রতিষ্ঠিত। • ‎সকলেই মরে, কিন্তু সকলেই আর প্রেমে পড়ে না। • ‎অন্ধকারেরও একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরেও গুপ্তশক্তি নিহিত থাকে। যে ফুল দিনে ফোটে, রাত্রে তার জন্ম হয়- একথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং নবযুগে যেসব মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে মধ্যযুগে সেসব বীজ বপন করা হয়েছিল। • ‎পুরাকালে মানুষ যা কিছু গড়ে গেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সমাজ হতে আলাদা করা, দুচার জনকে বহু লোক হতে বিচ্ছিন্ন করা। অপরপক্ষে নবযুগের ধর্ম হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন করা, সমগ্র সমাজকে ভাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করা। • ‎লেখক ও পাঠকের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দন্ডায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে যায়। চারচক্ষুর মিলনও ঘটে না। • ‎প্রাচীন ভারতবর্ষও রূপ সম্পর্কে অন্ধ ছিল না কারণ আমরা যা বলিনা কেন সেই সভ্যতাও মানব সভ্যতা- একটা সৃষ্টিছাড়া পদার্থ নয়। সে সভ্যতারও শুধু আত্মা নয়, দেহও ছিল। সে দেহকেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা সুন্দর, সুঠাম করে গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। সে দেহ আমাদের চোখের সামনে নেই বলেই আমরা মনে করি যে সেকালে যা ছিল তা হচ্ছে শুধু অশরীরী আত্মা। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য থেকেই প্রমান পাওয়া যায় যে তাদের কতটা সৌন্দর্য জ্ঞান ছিল। আমরা যাকে সংস্কৃত কাব্য বলি তাতে রূপবর্ণনা ছাড়া বড় কিছু নেই। আর সে রূপবর্ণনাও আসলে দেহের, রমনীদের রূপ বর্ণনা। • ‎এদেশে লাইব্রেরীর স্বার্থকতা হাসপাতালের থেকে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের থেকে কিছু বেশি। • ‎তাকেই যথার্থ সমালোচক বলে স্বীকার করি যিনি সাহিত্য রসের যথার্থ রসিক। • ‎সাহিত্যের হাসি শুধু মুখের হাসি নয়, মনেরও হাসি। এ হাসি হচ্ছে সামাজিক জড়তার প্রতি প্রানের বক্রোক্তি, সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্রদৃষ্টি।





বনফুল ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু বাণী বনফুল ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু বাণী Reviewed by Wisdom Apps on সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.